একুশে আইন, ট্যাঁশ গরু, বোম্বাগড়ের রাজা ও অন্যান্য বাচালতা

 একুশে আইন, ট্যাঁশ গরু, বোম্বাগড়ের রাজা ও অন্যান্য বাচালতা

 

১। “ সভায় কেন চেঁচায় রাজা 'হুক্কা হুয়া' ব'লে ?

লেখা, সংবিধান নিয়ে, কোনখান থেকে আরম্ভ করবো? ভাবি, কোনখান থেকে পারে আরম্ভ হতে? আরম্ভ হতে পারেনা কি এখান থেকেঃ

“শিব ঠাকুরের আপন দেশে, /  আইন কানুন সর্বনেশে !  /  কেউ যদি যায় পিছ্‌লে প'ড়ে / প্যায়দা এসে পাক্‌ড়ে ধরে, / কাজির কাছে হয় বিচার /   একুশ টাকা দণ্ড তার”

কিংবা

“কেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা / ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত ভাজা ?

ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে ? / টাকের 'পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে ?”

 

নাকি ৭০ দশকের সেই যুগান্তকারী দেওয়াল লিখন কে উদ্ধৃত করেঃ

“পার্লিয়ামেন্ট শূয়োরের খোঁয়াড়”?

 

সংবিধান, সে ভারতবর্ষেরই হোক কিংবা মঙ্গলগ্রহেরই হোক, যে ছবিগুলি আমার মনে আনে তারা হয় ওই “শিবঠাকুরের দেশ” নয়তো “বোম্বাগড়ের” রাজা আর রানীর আর নয়তো ঢালু বেয়ে অতি দ্রুত মৃত্যুর চেয়েও গভীর কোনো গাড্ডায় গড়িয়ে পড়ে যেতে একজন মানুষের। বাঁচার নিমিত্ত আঁকড়ে ধরবার মতো নেই একগাছি ঘাসও। ঠিক তখনই তার হাতে লাগলো ছোট, ছোট্ট একটা কিছু। কি? দেখবার, বুঝবার সময় নেই। যদি সাপ হয়? হলে হবে। মরণ তো দুদিকেই। অতএব ওই 'ছোট, ছোট্ট একটা কিছু'ই আঁকড়ে ধরলো সে এবং টের পেলো সে আর গড়িয়ে নামছেনা খাদের দিকে। তখন সাহসে ভর করে আস্তে আস্তে চোখ মেল্লো মানুষটি। ক্রমে তাকালো সে তার প্রাণরক্ষাকারী ওই ছোট, ছোট্ট একটা কিছু'র দিকে। এবং দেখলো ...

দেখলো সে আঁকড়ে ধরে আছে ল্যাজ, ছোট্ট ল্যাজ, একজন বেশ নাদুস নুদুস অবতারের এবং সেই অবতারজন বরাহ। হ্যাঁ, সেই বিষ্ণুর অবতার যিনি হিরণ্যাক্ষ-রাক্ষসের হাত থেকে, পুরাণমতে, ভূদেবী বা পৃথিবীকে একদা উদ্ধার করেছিলেন।  

সেই বরাহ অবতারের কৃপায় লোকটি, অন্ততঃ তখনকার মতো রক্ষা পেলো খাদে গড়িয়ে পড়ে মরার হাত থেকে। ঠিক। কিন্তু কতোক্ষণ? কপাল ভাল হলে সে বেঁচেও যেতে পারে সে যাত্রা। ধীরে ধীরে উঠে আসতে পারে খাদের ঢালু থেকে। আবার অবতারের পুচ্ছটিসহ ছিঁড়ে পড়ে যেতে পারে খাদে। বরাহ অবতার খেপে গিয়ে কিংবা ভয় পেয়ে অথবা অন্য যে কোনো কারনে, দিতে পারে দৌড় তার হাত ছাড়িয়ে।

অর্থাৎ এই ল্যাজ ধরে ঝুলে থাকা নয় কোনো পাকাপাকি সমাধান তবু কখনো তা'ই হয়ে ওঠে বাঁচবার এক ও একমাত্র সম্ভাবনা।

“কখনো” মানে ঠিক কখন? কখন মানে যখন

কেউ যদি যায় পিছ্‌লে প'ড়ে

প্যায়দা এসে পাক্‌ড়ে ধরে,

কাজির কাছে হয় বিচার

        একুশ টাকা দণ্ড তার”

কিংবা যখন ওঠে এই রকমের প্রশ্নগুলিঃ

“ সভায় কেন চেঁচায় রাজা 'হুক্কা হুয়া' ব'লে ?
মন্ত্রী কেন কল্‌সী বাজায় ব'সে রাজার কোলে ?”

 

প্রশ্ন ওঠে মনে কিন্তু প্রশ্ন করলেই একুশে আইনের কোনো একটিতে হয় তুমি “দেশদ্রোহী”, নয়তো “উগ্রবাদী” আর নয় “আর্বান নকশাল”। এক্ষেত্রে প্রশ্ন, সেই ‘একুশে আইন’ আসে কেন? আসে কোত্থেকে? আসে কখন? এই “একুশে আইন” আসে তখনই যখন মস্ত মস্ত মস্ত্‌ মস্ত্‌ বড়লোকেরা দেখে, যে, তাদের ব্যবসা আর তেমন লাভ দিচ্ছেনা, যখন মস্ত বড়লোককে গিলে খায় আরো মস্ত বড়লোক। আরো মস্ত কে আরো আরো মস্ত। যখন সে আর দেখতে পায়না এই ‘বিমারী’ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ ( যে পথ নেই আসলেই ) তখুনি সে তার হুঁকা ও হুকুমবরদার যাদের আমরা জানি ‘রাষ্ট্র’ বলে ‘সরকার’ বলে তাদেরকে ডেকে হিসেব চায়। বলে এতো এতো এতো ডলার খুইয়ে তোদের জিতিয়ে আনলাম আর এই তার ‘রিটার্ণ’? তখুনি নেমে আসে একুশে আইন। বোম্বাগড়ের রাজা আদেশ দেয় গায়ে খেটে খাওয়া ‘ছোটোলোক’দের কাজ করবার সময় ৮ থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘন্টা হোক। তাতেও বড় বড় মস্ত মস্ত মস্ত্‌ মস্ত্‌ ডলারবাবাদের পেট না ভরলে তা বাড়িয়ে করা হোক ১৬ ঘন্টা, ২৪ ঘন্টা। দিনে ৪৮ ঘন্টা হতেই ক্ষতি কি? এরকম অবস্থায় আনা হয় রাষ্ট্রপতি শাসন, ইমার্জেন্সিও। এই রকম সময়েই যে সংবিধান যা সং দিগের দ্বারা তাঁদের পিতামহ ধনিক শ্রেণীর স্বার্থকে রক্ষার নিমিত্ত লিখিত ও পুনর্লিখিত কিছু বিধান তাকেও উল্টে দেওয়া হয় কিম্বা তাকে সাক্ষীগোপাল বানিয়ে বলী চড়ানো হয় ‘ছোটোলোক’দের, ‘ছোটোজাত’দের। শিবের সেনা নামে গ্রামে গ্রামে। আর তখনই আমাদের, অর্থাৎ কিছু কিছু বুঝতে পারা ‘আম’ জনতার সাময়িক বেঁচে থাকবার নিমিত্ত আঁকড়ে ধরতে হয় এই  'ছোট, ছোট্ট একটা কিছু' আর এর নামই 'সংবিধান'। সংবিধান,  যা সং দিগের দ্বারা তাঁদের পিতামহ ধনিক শ্রেণীর স্বার্থকে রক্ষার নিমিত্ত লিখিত ও পুনর্লিখিত কিছু বিধান। আর যেহেতু সে, হয়, ছোট্ট একটি ল্যাজ মাত্র, অতএব সম্পূর্ণ অবয়বটিকে বাদ দিয়ে তার অস্তিত্ব অনর্থক। তাকে নিয়ে আলোচনা নিরর্থক। তাই কানের টানে মাথার মতো ল্যাজের টানে আস্ত ওবতারটিকে নিয়ে আলোচনাভিন্ন গতি থাকেনা।

সংবিধানের আঁতুড়ঘর সং-সদ কে  লেনিন তো কবেই বলেছেন "Bourgeois parliament is pigsty” আর “revolutionaries don't work in pigsty”। তবে লেনিনই এ’ও বলেছেন, যে,প্রয়োজনে, এই শূয়োরের খোঁয়াড়েও ঢুকে পড়তে হবে বিপ্লবীদের, শূয়োর সেজেই এবং নগ্ন করে দিতে হবে এর pigsty চেহারা এবং চরিত্রকে। সংসদ এবং সংবিধান নিকটাত্মীয়। একে অন্যের, কখনো পিতা, কখনো সন্ততি। আর এদের দাদাটির নাম ‘গণতন্ত্র’ যা লেনিনের কথায় "democratic republic is...[the] best possible political shell for capitalism." হ্যাঁ, এই গণতন্ত্র বজায় রেখেই যায় ‘একুশে আইন’ আমদানী করা, যায় ‘সিংহাসনে বসে হুক্কাহুয়া’ ডাক তোলা। যায়, কেননা এই গণতন্ত্রও যে মস্ত মস্ত মস্ত্‌ মস্ত্‌ বড়লোকদের আরো আরো আরো বড়লোক হওয়ার পথকে নিরংকুশ করবার প্রয়োজনেই গড়া। কাজেই তার অস্তিত্ব, স্থায়িত্বও নির্ভরশীল ওই বড়লোকদের বাণিজ্য পরিস্থিতির স্থিরতার উপরেই।

এঞ্জেলস্‌ লিখেছিলেনঃ So long as the state exists there is no freedom. When there is freedom, there will be no state লিখেছিলেন কেননা উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব, যে দ্বন্দ্ব মুনাফার,লাভের সঙ্গে উৎপাদনকারী শ্রমিকজনের পরিশ্রমের, তাকে আবডাল করতেই রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের আমদানি। এই যন্ত্র না থাকলে বেশী মজুরী দাবী করা শ্রমিককে দমন করবে কারা? তারাই যে আদতে মালিক এই বিশ্বের সে কথা বলতে আসা কমিউনিস্টদের জেলে দেবে কারা? জেল বানাবে কারা? পুলিশ ও মিলিটারি নামের গুন্ডাবাহিনী গড়া হবে কিসের দোহাই দিয়ে? কিসের দোহাই দিয়ে নেওয়া হবে ট্যাক্‌সো? আর সেই ট্যাকসো দিয়ে পোষা হবে পুলিশ, মিলিটারি পুঁজিবাবাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা এবং পুঁজিবাদের সর্বাত্মক রক্ষণাবেক্ষনের নিমিত্ত? মজুর, খেত মজুর, বেওয়ারিশ মজুরদের যাপনমানের অবনতি ঘটিয়ে তা থেকেও লাভ ছেঁচে নেওয়ার সময়ে ওই শ্রমিকদের ঘরছাড়া করবে কে? কারা? করবে আইন, মিলিটারি, পুলিশ, আইপিসি, ধারা, সংসদ। আর কে? এক কথায় রাষ্ট্রযন্ত্র। অতএব মুক্ত মানুষের পৃথিবীর মানচিত্রে কাঁটাতার নেই, রাষ্ট্র নেই। আর রাষ্ট্র থাকলে মুক্তি নেই। কিন্তু যখন ‘একুশে আইন’ আর শুধু ‘একুশে আইন’ হয়ে থাকেনা, যখন তা হয়েওঠে ‘ফ্যাসিবাদ’, তখন ওই বরাহ অবতারটিকে সামনে নিয়েই হয়, হবে, হয়েছে এগোতে।

          অর্থাৎ সং-বিধান ও সংসদের উপযোগিতা, প্রয়োগ অনুষঙ্গ বিশেষে একেক রকম। এই মুহুর্তে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ,না, দাঁড়িয়ে নয়, আমরা এখন সেই খাদের দিকে দ্রুত গড়িয়ে যাওয়া লোকটি।  ফ্যাসিবাদের বিষ ধোঁয়া, হিটলারের জার্মানীর মতো, অদ্য আমাদের ঘিরে ধরছে ঘনতম কুয়াশার অবয়বে। এমন একটি সময়ে, আদতে প্রতিজন চক্ষুষ্মান মানুষের, বিশেষতঃ যাঁরা মার্কস-লেনিন-মাও’এর দেখানো পথের পথিক, তাঁদের একটিই কর্তব্য তা এই ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে ব্যারিকেড গড়ে তোলা এবং পরের স্তরে তাকে আক্রমণ। এখানে আরো একটা কথা বলে রাখি, যা আমার নিয়তই মনে হয়েছে, মনেহয়, তা এই, যে, এই ব্যারিকেড গড়ে তোলা সক্রিয় রাজনৈতিক প্রয়াসের দ্বারাই শুধু সম্ভব। সক্রিয় কমিউনিস্ট রাজনৈতিক প্রয়াস যে প্রয়াস ভোটসর্বস্ব তথাকথিত বামপন্থীদের এজেন্ডা নয়, ছিলোওনা কোনোকালে। এই প্রয়াস কোনো নিছক ভালোমানুষের বা একদল, কয়েকদল মানুষের সমাজহিতের প্রয়াস নয়। সমাজহিতের প্রয়াস, ‘রাম-রোটি-ইন্‌সাফের’ থেকে মুক্তি পাওয়ার নিমিত্ত সুস্থ সাংস্কৃতিক প্রয়াস এই সকলই উপরিকাঠামোয় দরকারী তবে অন্তিমে সেগুলি প্রকৃত মার্কস-লেনিন-মাও পথে এসে না মিলে গেলে সকলই পন্ডশ্রম। এই মিলে যাওয়া ‘ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ি’র ভাঙ্গা দরজা’ যিনি মেলান তাঁর কম্মো নয়। এই মেলানো সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মীদের দায়িত্ব।

                         এই সমস্তই বহুকথিত, বহু আলোচিত তথাপি এই মুহুর্তেও ‘এনআরসি লাগাও, দাঙ্গা বাধাও’, ‘মন্দির এহি বানায়েংগে’, ‘বোরখা পুড়িয়ে খাক করেঙ্গে’ , ‘কাশ্মীর ফাইল ফ্রি মে দিখাকে পাব্লিক কো আউর দাঙাবাজ বানাও’, প্রকাশ্য সভায় 'মুসলমান নিধন করো' ঘোষণা , নিতান্ত নির্দোষ উমর খালিদের অনন্ত জেলবাস, স্টেন স্বামীর হত্যা (  "It is strongly believed by those closest to him that his death was caused (in view of his age and past health conditions) due to his arrest and prison conditions including inadequate health facilities and health care". HC asked the petition to be resubmitted) সমস্তই ঘটে যাচ্ছে প্রকাশ্যে এমন কি সংসদ-সংবিধান-সর্বোচ্চ আদালত-বিচারপতি ইত্যাদিদের দ্বারা ‘পবিত্র’ করে নিয়ে। অর্থাৎ সংবিধান হারিয়ে ফেলেছে তার বুর্জোয়া সংজ্ঞাও আর তা’ই স্বাভাবিক। কেননা ভারতবর্ষে এখন ফ্যাসিবাদ ষ্পষ্ট-ঘোষিত। এ’ও স্বাভাবিক কারণ আমরা জানি, যে, লেনিনের ভাষায় বল্লেঃ  "Decay of Capitalism” ই ফ্যাসিবাদ। বিশ্বপুঁজিবাদের পুঁজ আবারো নগ্ন হয়ে পড়েছে। তার মাছি ভন্‌ভন্‌, ঘৃণ্য ক্ষতগুলি আবারো দেখা যাচ্ছে খালি চোখে। অতএব এই তো সময় ফ্যাসিবাদের উল্লম্ফনের। আবারো বলি এমন একটি সময়ে, আদতে প্রতিজন চক্ষুষ্মান মানুষের, বিশেষতঃ যাঁরা মার্কস-লেনিন-মাও’এর দেখানো পথের পথিক, তাঁদের একটিই কর্তব্য তা এই ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে ব্যারিকেড গড়ে তোলা এবং পরের স্তরে তাকে আক্রমণ। এই ব্যারিকেড গড়ে তোলা সক্রিয় কমিউনিস্ট রাজনৈতিক প্রয়াসের দ্বারাই শুধু সম্ভব।

ফ্যাসিবাদ বিষয়ে বিশদ হওয়ার আগে এটুকু এখানে বলে রাখি, যে, 'ফ্যাসিবাদ' শব্দটি বহুদিন ধরেই ভুল ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অতি-দক্ষিণ কার্য কলাপ কে অনেকেই অজ্ঞানতাহেতু ফ্যাসিবাদ বলেছেন, বলে থাকেন আর আরেকদল, যাদের রাজনীতি মানে যে কোনো রকমের ব্যক্তিগত ও বিদেশী পুঁজিকে লালজলে ধুয়ে নিয়ে অতঃপর যে কোনো মূল্যে তাদের দরজা খুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা,তারা ইচ্ছে করেই অপব্যবহার করে ফ্যাসিবাদ শব্দের যাতে আদত ফ্যাসিবাদের কিনারে গিয়ে তারা দাঁড়ালেও জনতার চোখে, থুড়ি, ভোটারদের চোখে তা যায় ঝাপসা হয়ে।

(  হ্যাঁ বন্ধুরা, আমি স্বীকার করছি বড় পুরনো, বড় ক্লিশে হয়ে যাওয়া শব্দ এগুলো। বাক্যগুলিও। কিন্তু আমিও নিরুপায়। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ আমার এগারো-বারো কেলাস। তখনো ছাত্র রাজনীতি কথাটা ছিল। ফলতঃ এই সমস্ত শব্দ, বাক্য তখনো উড়তো বাতাসে। একটি দুটি মগজে ঢুকে গিয়ে আলোড়নও বাধাতো এরা। কিন্তু, ক্রমে, বিশ্ব পুঁজির জন্য দরজা যতোই খুলতে লাগলো ততোই দেখলাম প্রকাশ্য ছাত্র রাজনীতিকে মুছে দেওয়া। দেওয়ার চেষ্টা। বিশেষ করে এই সকল শব্দ,বাক্য বলা রাজনীতিকে। এইতো সেদিনো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে এরকমই কিছু ক্লিশে কথাবলা ছেলেমেয়েকে তুলে নিয়েগেলো পুলিশ। আটকে রাখলো নির্বিচারে। মেয়েদের কে হুমকি দিল পুলিশ 'বিপ্লব করবি! দেবো গলাটিপে থুড়ি রেপ করে'। হ্যাঁ, এই সমস্তই রনো গুহ নিয়োগীর, দেবী রায়ের উত্তরাধিকার। ... তাহলে শব্দগুলি, এই বাক্যগুলি ততোটা ক্লিশে নয়? এই সব শব্দে, বাক্যে আজো ছ্যাঁকা লাগে রাষ্টের গায়ে! তাহলে বন্ধুরা, আমিও আওড়াতে বাধ্য সেই ক্লিশে কথাগুলিই। যদি বাতাসে উড়তে উড়তে তারা ঢুকে যায় একটি দুটি মগজে ...এই আশায়। এই ভরসায়। )

 

                                   "Decay of Capitalism” বলেছেন লেনিন ফ্যাসিবাদকে। ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের পচনজাত বিকৃতি। আবার পুঁজিবাদের পূঁজ যে অবয়বে দানা বাঁধে তার নাম রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র আবার পুঁজিবাবাদের, পুঁজিবাদের হাতে কখনো পুতুল, কখনো অস্ত্র। তাই অগ্রে রাষ্ট্র শব্দটির নাড়িভুঁড়ি খুলে দেখতে হয় । আগেই বলেছি, এঞ্জেলস্‌ লিখেছিলেনঃ So long as the state exists there is no freedom. When there is freedom, there will be no state লিখেছিলেন কেননা রাষ্ট্র থাকলে ভোট আছে। বিজেপির ইলেকশন ফান্ডে টাকা ঢালবার পুঁজিপতি আছে। সেই টাকায় নানান ফিকির, খুন, দাঙ্গা করে মসনদে আসীন হওয়া আছে। আছে সংসদ। সংবিধান। আছে সেই পুঁজিবাবা দের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবার সম্পূর্ণ তাগিদ। ভারতীয় কৃষিতে বিদেশী পুঁজিকে অবারিত করবার অদম্য চেষ্টা। অথবা শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সমর্থনের জিগীর তুলে যুক্ত ফ্রন্ট গড়ে নিয়ে চাষীদেরই গুলি করে মারা। সেই সংগ্রামরত চাষীদের সমর্থনে এগিয়ে আসা ছাত্রছাত্রীদের হত্যা। তাদের নেতা্দেরকে গুমখুন।

স অ ব আছে। আছে সংবিধান। আছে সংসদ। কিন্তু এগুলি থাকলে মুক্তি, মানুষের, নেই।

রাষ্ট্র থাকলে আছে রাষ্টের হেজিমনি। গপ্পো। যে গপ্পো আদতে রাষ্ট্র গড়ার কারিগর পুঁজিবাবাদের সমর্থন আদায় করে নেওয়ার গুলগপ্পো। সেই গুলগপ্পো যে বা যারা হজম করেনা, করতে পারেনা কিংবা প্রশ্ন তোলে সর্বসমক্ষে  তাদেরই দেশদ্রোহী বলার যথেচ্ছ ক্ষমতা। যে কোনো আন্দোলনকে, আন্দোলনকারীকে সন্ত্রাসবাদী ফতোয়া দিয়ে খুন করা কিংবা 'স-মা-ধা-ন' মিশনের নামে আদিবাসী হত্যা।

( হায় রাষ্ট্র, হায় পুঁজিবাদ, কতোই তো মেরেছো, মারছো মারবে, তবু, মার্ক্সবাদে এখনো তোমরা সেই প্রথম দিনের মতোই ভীত। "A spectre is haunting Europe — the spectre of communism. All the powers of old Europe have entered into a holy alliance to exorcise this spectre: Pope and Tsar, Metternich and Guizot, French Radicals and German police-spies. " হায়, এখন আর ইউরোপ নয়, সমগ্র বিশ্ব ওই কমিউনিস্ট জুজুর ভয়ে ভীত। ওই ভীতি থেকেই নিত্য নতুন ফিকির খুঁজছে টাকাবাবা আর ডলারবাবারা, দৃষ্টি, মানুষের, ফিরিয়ে রাখবার, ঢেকে রাখবার। কিন্তু সফল হচ্ছে কি? যদি হতো তাহলে এই মুহুর্তে লিখিত হতে পারতোনা এই সামান্য গদ্যটিও।)

                                                       আবার আরম্ভে ফিরে যাই। যে অবতারটির ল্যাজ ধরে এখনো ঝুলছে, আমার এই গদ্যের আরম্ভের গড়িয়ে যাওয়া মানুষটি, রাষ্ট্র সেই অবতারের খোলস, তার মগজ পুঁজিবাবা, তার পেট লাভ,লোভ,মুনাফা – এক কথায় পুঁজিবাদ। কিন্তু এই পেটফোলা অবয়ব নিয়ে গণেশবাবা জিন্দেগী কাটাতে পারেন, কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পারেনা। পারেনা, তা আমরা আগেও দেখেছি আর হালে, কোরোনার কৃপায়, আরো পরিষ্কার দেখলাম কিভাবে হাবুডুবু পুঁজিবাবারা, কিভাবে এই অতিমারীর সুযোগ নিয়েও লাভ করতে তারা ব্যস্ত, কিভাবে এই 'লক ডাইন'এর আড়ালে সক্কলের মাথা 'লক-আপ'এ রেখে তলে তলে পুকুর বেচার খেলা। কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল। নিশ্চয়। কিন্তু আবারো, সেই ডট্‌কম্‌ বাব্‌ল ফাটা যুগের মতোই, পরিষ্কার দেখা গেলো তাদের পূঁজ। তাদের গলিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। এই গলিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকেই জন্মায় ফ্যাসিবাদ। এই দেশেও জন্মেছে সেই কবে, বিশ্ববাজারের মন্দার হাত ধরে, হিন্দু মহাসভার হাঁটুতে ভর দিয়ে। কমরেড অভিনব সিন্‌হা (Revolutionary Workers' Party of India)'র জবানী তুলে দিলাম কেননা ভারতে ফ্যাসিবাদের জন্ম বিষয়ে এমন প্রাঞ্জল কথন অন্ততঃ আমি আর শুনিনি এতাবৎঃ Indian Fascism was not simply a derivative discourse. It came into existence in the period of Imperialism, the emergence of militant working class movement in India and the relative peripheralization of brahmanical and landlord forces in the national movement. It combined the nascent reaction of the feudal brahmanical forces as well as the Indian bourgeoisie and developed a very limited support base among the urban middle classes, especially traders. Classically, RSS was known as a brahmin-baniya organization. The late-1910s and the 1920s were the years when the ideology of Hindutva Fascism was being developed by Moonje and Savarkar."

 [ সম্পূর্ণ প্রবন্ধটির সূতোঃ https://redpolemique.wordpress.com/2016/06/09/the-resistible-rise-of-fascism-and-the-challenges-of-the-working-class-movement-in-india/]

এই মুহুর্তে আমরা এখানেই। এমন একটি সময়ে, আদতে প্রতিজন চক্ষুষ্মান মানুষের, বিশেষতঃ যাঁরা মার্কস-লেনিন-মাও’এর দেখানো পথের পথিক, তাঁদের একটিই কর্তব্য তা এই ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে ব্যারিকেড গড়ে তোলা এবং পরের স্তরে তাকে আক্রমণ। এখানে আরো একটা কথা বলে রাখি, যা আমার নিয়তই মনে হয়েছে, মনেহয়, তা এই, যে, এই ব্যারিকেড গড়ে তোলা সক্রিয় রাজনৈতিক প্রয়াসের দ্বারাই শুধু সম্ভব। সক্রিয় কমিউনিস্ট রাজনৈতিক প্রয়াস যে প্রয়াস ভোটসর্বস্ব তথাকথিত বামপন্থীদের এজেন্ডা নয়, ছিলোওনা কোনোকালে। এই প্রয়াস কোনো নিছক ভালোমানুষের বা একদল, কয়েকদল মানুষের সমাজহিতের প্রয়াস নয়। সমাজহিতের প্রয়াস, ‘রাম-রোটি-ইন্‌সাফের’ থেকে মুক্তি পাওয়ার নিমিত্ত সুস্থ সাংস্কৃতিক প্রয়াস এই সকলই উপরিকাঠামোয় দরকারী তবে অন্তিমে সেগুলি প্রকৃত মার্কস-লেনিন-মাও পথে এসে না মিলে গেলে সকলই পন্ডশ্রম। এই মিলে যাওয়া ‘ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ি’র ভাঙ্গা দরজা’ যিনি মেলান তাঁর কম্মো নয়। এই মেলানো সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মীদের দায়িত্ব।

 

২। “আসলেতে পাখি সে …”

 

আচ্ছা, সুকুমার রায়, কেন আমার এমনটা হয় বলতে পারেন? কেন এই সমস্ত প্রসঙ্গেই আমার মনে আসে আপনার কবিতাই শুধু? এই যেমন ‘ফ্যাসিবাদ’ আমাকে মনেপড়ায়ঃ

“ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে ;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে” …

দেখা যাচ্ছে, যে, ট্যাঁশ গরু” নামেই শুধু গরু কিন্তু  আদতে গরু নয়। ‘পাখি’। ঠিক যেমন “আচ্ছে দিনের” প্রতিশ্রুতি। “আচ্ছে দিন” আসবে। তবে “আসলেতে” আসবেনা যতক্ষণ না গড়ে তোলাযায় ‘রাম রাজ্য’, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। অর্থাৎ ‘গরু’ বল্লেও আসলে ‘পাখি’। আর “যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে”। নিশ্চয়। হারু-নাড়ু-অগলা-বগলা সক্কলেরই পেটে পেটে ওই এক কথা। “শালা মুসলমান খেদাও”। আচ্ছা, আমরা না ‘সেকুলার’, আর তাই আমাদের ইস্কুলে কলেজে ‘হিজাব’ নামের ‘ধর্মীয় পোষাক’ আমরা ‘এলাউ করিনা’, কিন্তু এই ‘সেকুলার’ দেশেই ইস্কুলে কলেজে সরস্বতী পূজা … আরে নাহ্‌। ওটা ‘ধর্ম’ নয় ‘সংস্কৃতি’। ঠিক যেমন ওই “ট্যাঁশ গরু” আদতে গরু নয়। ‘পাখি’। মুসলমান বিদ্বেষের নতুন নতুন ফর্মুলা নামানো আর সেগুলিকে পরীক্ষা করে দেখবার যে নতুন ল্যাবরেটরী হয়েছে কর্ণাটক, সেই কর্ণাটকেরই মহান ‘সিলিকন ভ্যালি’ বেংগালোর শহরে আমি দেখি, কি অবাধে আইটি-প্রো’রা নিজ ডেস্কে তিরুবাবা ইত্যাদির প্রসাদ রেখে অবলীলায় অফিসিয়াল ই মেইল ব্যবহার করে সব্বাইকে আমন্ত্রণ জানান প্রসাদ গ্রহনে। আরো একটু অগ্রনী যারা তারা তো মিটিং রুমে ডেকে বা কোনো অফিসিয়াল মিটিঙ্গের মধ্যেই বিলায় প্রসাদ। একদল হিন্দুরা কি এক তীর্থে যাওয়ার আগে-পরে কালো এক পোষাক পরিধান করে কিছু লোক। খালি পায়ে আসে অফিসে। আমাদের সরকারী, বেসরকারী কুত্রাপি আমি শুনিনি এ নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য। আবার রমজানকালে, নামাজের আগে মুসলমান এম্‌প্লয়ী যদি পা ধুয়ে ফেলে কোনো বেসিনে, তার জন্য পাহারাও বসতে দেখেছি বহুজাতিক সংস্থায়। তথাপি আমরা ‘সেকুলার’, তথাপি ভারতবর্ষ এখনো নয় ‘হিন্দু রাষ্ট্র’।

                     ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠকালে যে গুটিকয়ের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ গড়ে উঠেছিল ‘স’ তাদের একজন। সেইকালে ‘স’ গর্ব করে বলতো কমিউনিস্ট পার্টি বে আইনি ঘোষিত হলে তার বাবাকে করতে হয়েছিল কারাবাস। এম এ পরীক্ষা তিনি পাশ করেন বন্দী অবস্থায়। ইন্দিরার ইমার্জেন্সীতে আইন অমান্য করতে গিয়ে আবারো কারাবরণ। তার হবু পত্নীর ভগিনী ও তাঁর স্বামী একটি আদিবাসী জঙ্গি কমিউনিস্ট দলের সদস্য। তাঁদের প্রায়ই পালিয়ে থাকতে হয়। আলোচনা করতো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নিয়ে। তার ‘বন্ধু’ হিসেবে নিজেও গর্ববোধ করতাম বৈকি। ছাত্রদশা অন্তে যে দুয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কিংবা যোগাযোগ রাখবার মতো মনোবৃত্তি আমার ছিল, ‘স’ অবশ্যই তাদের একজন। ফোনালাপ ইত্যাদি হত মাঝে মধ্যে। তবে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ওঠেনি বহুদিন। হঠাৎই একদিন, CAA বাজারে নামার পরেই এলো তার টেক্সট-বার্তা “বরাক উপত্যকার হিন্দুরা বিপন্ন। কিছু একটা করতে হবে”। তাজ্জব!

এদ্দিন যাকে ‘পাখি’ ভাবতাম সে আদতে ‘গরু’ না’কি যাকে এদ্দিন ‘গরু’ ভেবে এসেছি সে আদতে ‘পাখি’? এই সমস্যা থেকেও উদ্ধার করলেন সুকুমার রায়। বল্লেনঃ “আরে, এ, হয় গরু এবং পাখি দুই’ই। এই হয় আমার ‘আবোল তাবোলের’ সেই “ট্যাঁশ গরু”।

                    “হিন্দুরা বিপন্ন”, শুধু হিন্দুরাই অবলা, দুর্বল, বিপন্ন! – এতো সেই ফ্যাসিবাদের শেখানো বুলি! এই আইন করার মর্মে, আমি যদ্দুর বুঝেছি, আছে এক রকমের ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা, সংখ্যালঘুদের মধ্যে, আছে এই আজব আইন জনিত ডামাডোলের আবডালে বিজেপি সরকারের চেষ্টা তার ‘স্পন্সর’ দের কাছে দেওয়া নাকখতগুলির শর্ত পূরন, আছে নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়ে আরোও শস্তায় পাওয়া যাওয়ার মতো শ্রমিকের নির্মাণ। কিন্তু ‘স’, যার মেরুদন্ড, কমিউনিস্ট ধ্যান ধারনায় সোজা ছিল একদা সে আজ কি বলছে? তবে খুব বেশীদিন ‘স’ আমাকে রাখলোনা সাসপেন্সে। পাঠাতে লাগলো সঙ্ঘী আইটি সেলের সব ভিডিও, বার্তা ইত্যাদি। তর্কে গেলাম না। ব্লক করে দিলাম। সম্পর্ক দিলাম ছেদ করে। তর্কে গেলাম না কেননা আমরা জানি, যে, ফ্যাসিবাদী এক নাৎসী নেতার নিজ জবানীতেই “তর্ক দ্বারা আমাদের নিধন সম্ভন নয় কেননা আমাদের জন্মের ইতিহাসেও কোথাও তর্ক নেই”। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ জন্মই নেয় সমস্ত অযৌক্তিকতাকে সম্বল করে। মড়ে যাওয়া রক্ত কণিকাকে খেয়ে। তার কাজ একটাই যথাসময়ে সমস্ত মানবজাতিকে তার পুঁজিবাবার স্বার্থে কাজে লাগানো। ‘স’ আটকা পড়েছে এই ফ্যাসিবাদের জালে। আটকা পড়েছে ঠিক মাছির মতোই। চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত, সে বড় বেতনের হোক আর ছোট বেতনের, হোক সে সরকারী , হোক বেসরকারী তার নৈকট্য, রাজনৈতিক শ্রেণী হিসেবে, যাদের শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছু নেই হারাবার, তাদের সঙ্গেই, মর্মে মৃত সামন্তবোধজাত অহং তাকে সতত পুঁজিবাবাদের দিকে ধাবিত করলেও। ফলতঃ হিন্দু মহাসভা কিংবা পরে আরএসএস মধ্যমিত্ত, তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ দের কাছে কল্কে পায়নি বহু বছর। বাজার মন্দা সত্ত্বেও। কিন্তু রাম জন্মভূমি পর্বে কিছুদূর এবং পরবর্তীতে বহুদূর এবং অধুনা মুক্তকচ্ছ হয়ে ‘স’ হেন হিন্দু মধ্যবিত্তরা ফ্যাসিবাদের একেকজন মুখপাত্র এবং এই কারণেই ‘সংঘী হিন্দুত্ব’ই অদ্য ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়াশীলতার অপর নাম। ফ্যাসিবাদের নামান্তর।

 

 

                              এই “ট্যাঁশ গরু” কিংবা ফ্যাসিবাদের মূল সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। তবে ভারতীয় অনুষঙ্গে ফ্যাসিবাদের চাহারাটি নিয়ে কিছু উল্লেখের থেকে যায়। এই সময়ের মার্ক্স-লেনিন-মাও পথের দুই চিন্তক তথা কর্মী কমরেড অভিনব সিন্‌হা (Revolutionary Workers' Party of India)  আর কমরেড দীপংকর ভট্টাচার্য্য [CPIML(Liberation)] যদিও দুটি ভিন্ন শিবিরের এবং ভিন্ন প্রজন্মের তথাপি তাঁদের ভারতীয় ফ্যাসিবাদ নিয়ে ভাবনায় আমি নৈকট্য লক্ষ্য করি। ফ্যাসিবাদ বলে এমন এক সর্ব-সমস্যা-হর অতীতে জনতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা যে অতীত আদৌ ছিলই না। ভারতে সঙ্ঘীরা একেই বলে “রাম রাজত্ব”। (‘রাম রাজত্বের’ মূলো দেখিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদও কিন্তু তার চরিত্রটি ফ্যাসিবাদী না হওয়ায় হিন্দু মহাসভা ওই মূলো পাতে তোলেনি এবং পরে আরএসএস বাধ্য হল খুন করাতে মোহনদাস করমচাঁদকে। ) এই মিথ্যা অতীতে ফিরে যাওয়ার পথে ফ্যাসিবাদীরা আমদানী করে কাল্পনিক শত্রুর। সংঘীদের ‘মুসলমান’, নাজিদের ইহুদী। ক্রমে এই গুল গপ্পোটিকে তারা করে তোলে হেজিমনি – একদা গোয়েবল আর হালের হোয়াটসেপ্‌, ফেবু,টুইটার, অন্যান্য গণ মাধ্যম যাতে পালন করে, করছে দূতের, দূতীর ভূমিকা। তারা তোয়ের করে গোপন ক্যাডার বাহিনী। ভারতে এই বাহিনী আরএসএস। এইভাবে তারা তোয়ের করে নেয় তাদের একটি অবস্থান। অতঃপর তারা, সিলেটিতে যাকে বলে “খাপ পেতে থাকে” । যে মুহুর্তে পুঁজির বাজারে মন্দা নামে, যে মুহুর্তে পুঁজিবাবাদের সংকট উপস্থিত, তক্ষুনি গণচক্ষু থেকে সেসব আড়াল করে আপামর জনতাকে পুঁজির বৃহত্তম বাবাদের স্বার্থে কাজে লাগায়, সামান্য ছল-কৌশল আর ৯৯ শতাংশ বল দ্বারা। এমনি এক মন্দায় তাদের জন্ম, বৃটিশ যুগে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় হয়ে। আরেক বাজার মন্দার সুযোগ নিয়ে তাদের ‘করসেবা’, বাবরি-রাম দাঙ্গা। আর হালের মন্দায় তারা খোলা তলোয়ার হাতে গৌরী লঙ্কেশ হত্যা থেকে ‘এনআরসি লাগাও, দাঙ্গা বাধাও’, ‘মন্দির এহি বানায়েংগে’, ‘বোরখা পুড়িয়ে খাক করেঙ্গে’ , ‘কাশ্মীর ফাইল ফ্রি মে দিখাকে পাব্লিক কো আউর দাঙাবাজ বানাও’, প্রকাশ্য সভায় 'মুসলমান নিধন করো' ঘোষণা , নিতান্ত নির্দোষ উমর খালিদের অনন্ত জেলবাস, স্টেন স্বামীর হত্যা ইত্যাদির দ্বারা জানান দিচ্ছে যে ফ্যাসিবাদের ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা শ্রম, হিন্দু মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে মুসলমানদের উঠে যাওয়ার হুমকি, হচ্ছে নতুন নতুন অনর্থক কিংবা অনর্থ শব্দ আমদানি করে সেগুলির ভিত্তিতে চোখ-কান খোলা রেখে চলা যে কোনো মানুষের মানবাধিকারে আক্রমণ, যথা 'আর্বান নকশাল' শব্দটি।

( হায়! নকশাল বোধগম্য এবং শ্রদ্ধা মিশ্রিত একটি শব্দ। তেভাগা-তেলেঙ্গানার উত্তরসূরী। কিন্তু 'আর্বান নকশাল', কি এর অর্থ? নকশাল বলতে যদি মার্ক্স, লেনিন,মাও এর প্রদর্শিত পথে চলা রাজনৈতিক ধারাকে বোঝায়, তাহলে 'আর্বান নকশাল' আর 'রুরেল নকশাল' ... যেন সুকুমার রায়ের 'হাতিমি'।)

এই সময়ের মার্ক্স-লেনিন-মাও পথের দুই চিন্তক তথা কর্মী কমরেড অভিনব সিন্‌হা (Revolutionary Workers' Party of India)  আর কমরেড দীপংকর ভট্টাচার্য্য [CPIML(Liberation)] যদিও দুটি ভিন্ন শিবিরের এবং ভিন্ন প্রজন্মের তথাপি তাঁদের ভারতীয় ফ্যাসিবাদ নিয়ে ভাবনাগুলি পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে আমার মনেহয় উক্তদের সঙ্গে এবং আমার সঙ্গেও পথ বা শিবির ভিন্ন হলেও সেই কমরেড শিবদাস ঘোষের (SUCI) ১৯৫৭ তে লেখা Crisis in Culture, and Fascism নিবন্ধটি যা আমাকে ২য় বার পড়তে বাধ্য করে আমার ১৯ বছরের CPIML(Liberation) এর কর্মী, পুত্র। ১৯৫৭ সালে কমরেড শিবদাস ঘোষ লিখেছেনঃ Fascist culture conducive to the fascist economic structure developed in Germany also. In our country, in spite of the constant canting of democracy, signs of fascism are becoming more and more manifest in the state-structure and in the economic life. And even in the bourgeois culture of our country their reflections are assuming more and more naked forms day by day as a historical inevitability. On one side, it is loudly proclaimed that 'India is a secular state' and, on the other, the statesmen and the political leaders are patronizing directly or indirectly, all sorts of religious functions and customs, and in support of their behaviour, they are giving a novel interpretation of secularism. According to them, a secular state is one which is not based on any one particular religion, but provides equal encouragement and full support to flourish of all religions. What a peculiar interpretation! Every student of history and social science knows that the word secularism means; worldly and non-recognition of any supernatural entity. [ সম্পূর্ণ প্রবন্ধটির সূতোঃ https://www.marxists.org/archive/shibdas-ghosh/1957/x01/x01.htm]

পুত্রের উল্লেখের হেতু এই, যে, সে আরেক প্রজন্ম। কমরেড অভিনবেরো পরের। অর্থাৎ বিপ্লবের পথ নিয়ে ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্ম – সমস্ত সত্ত্বেও ভোট-সর্বস্বতার উর্ধে থাকা কমিউনিস্ট দলগুলিই শুধু চিনতে পেরেছিল ফ্যাসিবাদকে। আজকেও তাদের কাছেই আমরা পাচ্ছি ভারতে ফ্যাসিবাদের উপস্থিতির নগ্ন সত্যের তথ্য ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। অতএব এই মুহুর্তে, যখন বুর্জোয়া সংবিধানও চলে যাচ্ছে তার বুর্জোয়া সংজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে, ফ্যাসিবাদের দিকে তখন সমস্ত মানুষের কর্তব্য এই ফ্যাসিবাদের চরিত্র উদ্ঘাটন ও এই ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে ব্যারিকেড গড়ে তোলা এবং পরের স্তরে তাকে আক্রমণ। এখানে আরো একটা কথা বলে রাখি, যা আমার নিয়তই মনে হয়েছে, মনেহয়, তা এই, যে, এই ব্যারিকেড গড়ে তোলা সক্রিয় রাজনৈতিক প্রয়াসের দ্বারাই শুধু সম্ভব। সক্রিয় কমিউনিস্ট রাজনৈতিক প্রয়াস যে প্রয়াস ভোটসর্বস্ব তথাকথিত বামপন্থীদের এজেন্ডা নয়, ছিলোওনা কোনোকালে। এই প্রয়াস কোনো নিছক ভালোমানুষের বা একদল, কয়েকদল মানুষের সমাজহিতের প্রয়াস নয়। সমাজহিতের প্রয়াস, ‘রাম-রোটি-ইন্‌সাফের’ থেকে মুক্তি পাওয়ার নিমিত্ত সুস্থ সাংস্কৃতিক প্রয়াস এই সকলই উপরিকাঠামোয় দরকারী তবে অন্তিমে সেগুলি প্রকৃত মার্কস-লেনিন-মাও পথে এসে না মিলে গেলে সকলই পন্ডশ্রম। এই মিলে যাওয়া ‘ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ি’র ভাঙ্গা দরজা’ যিনি মেলান তাঁর কম্মো নয়। এই মেলানো সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মীদের দায়িত্ব।

 

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

১৮ এপ্রিল ২০২২

বেংগালোর

 

জনমত

কয়েকটি প্রশ্ন, একটি ভূমিকা

“বেদনা কি ‘ভাষা’য় রে …”