“বেদনা কি ‘ভাষা’য় রে …”

“বেদনা কি ‘ভাষা’য় রে …”

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 

১।

ভাষা, হায়, সে'ও হয় "ক্ষমতা-খেলা"র একটি ঘুঁটি।

যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, একা আমি নই, আমি, তুমি, আমরা সকলে, তা আদতে দ্বীপ নয়। তা আদতে একটি বিরাট তিমিমাছের পিঠ। ওই তিমি মাছ আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। দেখছো না, সেদিনো যেখানে ছিল মানুষের বাস বসত, আজ সেখানেই হাহাকার, কান্নাকাটি, মাথায় হাত দিয়ে বসা শনচুল বুড়ি, রুগ্ন মুখ কাচ্চাবাচ্চারা, ভীত সন্ত্রস্ত বৌ'ঝি রা, কাচ্চাবাচ্চাগুলির বাপ-কাকা-মামা'রা। তাদের ঘিরে আছে ধ্বংস। তাদের ঘিরে আছে হাহাকার, বুলডোজার, লোভ, প্রতিশোধ আরো অনেক অনেক কিছু যা অন্ধকার, যা বিষাক্ত। ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে এদের ঘর। এদের কুঁড়েঘর, এদের বস্তিকোঠা, এদের তোলা উনুন, নামিয়ে দেওয়া হয়েছে রাস্তায়। এই ভেঙ্গে দেওয়ার, রাস্তায় নামিয়ে দেওয়ার ছবি তুলেছে সংবাদ-নির্মাতা আর বিক্রেতারা। ভিডিও শ্যুট করেছে বুলডোজারে বসে। হেসেছে। বলেছে 'এখন বুঝুক মজা। যতোসব বাংলাদেশী, উইপোকার দল। সরকারের জমি দখল করার ঠ্যালা সামলাক এখন ..." এদিকে একটি মধ্যরাত, যখন বুলডোজার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যখন তারা হয়তো ছিল ঘুমমত, হয়তো দিনের কাজের শেষে বসেছিল শস্তা মদ নিয়ে, হয়তো ... তখনো বুলডোজারের বিষাক্ত দাঁত ঝাঁপিয়েছিল। হাজির ছিল  রাষ্ট্র, অর্থাৎ পুলিশও। মস্তি দেখতে দেখতে, খৈনী ডলতে ডলতে হয়তো মন্তব্য করলো কান্না লুটিয়ে পড়া যুবতীর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ বিষয়ে। নিজেদের মধ্যে বা আওয়াজও দিল হয়তো। রাষ্ট্র নাকি জানিয়েছে আপাততঃ ভাঙ্গাভাঙ্গির দরকার নেই। 'রাষ্ট্রীয় ডালকুত্তা'দের কাছে নাকি পৌঁছেনি ওই খবর!কল্পনা করতে পারো ওই ত্রাস? ওই ভীতি? ওই ঘ পুড়ে যাওয়ার, পড়ে যাওয়ার হাহাকার? ওই শিশুগুলি, বালক-বালিকাগুলি, কিশোর-কিশোরীগুলির মর্মের ক্ষোভ? রাত কাটলো। এলো দিন। আরেকটা দিন। তাদের ছাদ-ছাড়া দিন। চলতে লাগলো ওই বিনাশলীলা। চলতে লাগলো সংবাদ-নির্মাতা, সংবাদ বিক্রেতা, সংবাদ ক্রেতা, মস্তিমারাদের ভিড়। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না,তোমাকেও, আমাকেও, ওই ভিড়ে? ওই ভিড়ের কোনো একটিতে কিংবা দুইটিতেই? তুমি কি এখনো টের পাচ্ছোনা যে ওই বুলডোজার আর ভাষা একই আগ্রাসনের দুই পিঠ? তুমি কি এখনো অনুভব করতে পারছোনা, শিরায় শিরায়, স্নায়ুতে স্নায়ুতে, যে, ভাষা, হায়, সে'ও হয় "ক্ষমতা-খেলা"র একটি ঘুঁটি।

তবে হে পাঠক, গো পাঠিকা, প্রথমেই জানিয়ে রাখি, যে, "ক্ষমতা-খেলা" শব্দবন্ধের এই ব্যবহার তার 'পোস্টমডার্ন' সংজ্ঞার থেকে দূরে শুধু নয় বিপরীতে কেননা এখানে আমার চেষ্টা ভাষা ভিত্তিক আগ্রাসনকে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাওয়ার আর আমার ক্ষুদ্র পাঠ ও বোধবুদ্ধিতে আমাকে টের পেতে হয়েছে, যে, পোস্টমডার্নিজমের জন্ম, বিস্তার –  সমস্তই মার্ক্সবাদকে সমূলে বিনষ্ট আর বিনাশ করবার তাগিদে, অবশ্যই বুর্জোয়া প্রভুদের দ্বারা।

                                   ''পোস্ট মডার্নিজম" এখানে আমার আলোচ্য নয় তথাপি কিছু প্রাথমিক কথা বলে রাখা প্রয়োজন। ''পোস্ট মডার্ন' এই  আহ্লাদী শব্দবন্ধের মধ্যেকার ফাঁক আর ফাঁকি র সমান্তরালে ফুকো-টুকো হেন দু চারজন মেধাবীর গোটা চিন্তায় না হলেও, তথ্য ও তার বিশ্লেষণের নানা স্থান্‌ সত্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অতোটুকুই।

                           বিশ্বে  পুঁজিবাদ যতদিন থাকবে, ততদিন পুঁজিবাদীরাও মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাও' এর ভাবনা প্রমুখকে আঘাত করতে, ভুল প্রমাণ করতে চেষ্টা নিয়েছে, নেবে বারবার। পুঁজিবাদ যতক্ষন পৃথিবীতে বিরাজমান ছিল স্বনামে ততোক্ষন তাকে শনাক্ত করাও ছিল সহজ। কিন্তু যখনই সে বাধ্য হল একটি পরোক্ষ চেহারায় নিজেকে হাজির করতে, সমস্যার জটিলতা তখুনি বর্ধিত হল কোটিগুণ। সুতরাং ২০শ শতকে পুঁজিবাদের সমর্থন আদায় করা, এমন কি নিতান্ত তৃণভোজী জনতার মধ্যেও, আর রইলো না ততোদূর সরল, যতোদূর সরল ভাবে ‘মুনাফা’র আবডালে ‘ঈশ্বরের হাত’কে ঘোষণা করতে পেরেছিল এডাম স্মিথ। তাই পুঁজিবাদের সমর্থন ও প্রচারকারীরা, এইবার, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবার খাতিরে, পুঁজিবাদের ভয়াবহতা চরিত্রটি স্বীকার করে নিলো ঠিক কিন্তু  ওই স্বীকারোক্তির আবডালে, নানান ধোঁয়াশা-তত্ত্বের সঙ্গে হাজির করলো, পরোক্ষে, এই দাবীও, যে পুঁজিবাদকে, তার সমস্ত বিকৃতি সত্ত্বেও উপড়ে ফেলা অসম্ভব । অসম্ভব কোনো ভিন্ন রকমের সমাজের প্রবর্তন।  ''পোস্ট মডার্নইজম’ এই সমূহ খন্ড প্রচেষ্টাকে একত্রিত করে একটি নির্মাণ করতে চাওয়া, বুর্জোয়া-স্পন্সর্ড, একটি শূন্য কলসী যার মৃত্যুও প্রায় হয়ে এসেছিল এবং মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এরা আবার, ‘জোম্বি’রূপ ধরে চেষ্টা নিচ্ছে উঠে দাঁড়ানোর।

        অতি বিস্তারে না গিয়ে, খানিকটা 'অতি সরল', বোধগম্যতার প্রয়োজনে, বলি, যে,  ''পোস্ট মডার্ন' এই  আহ্লাদীর মৌলিক ধারনাটি ( যে ‘মৌলিক’ এবং ‘ধারণা’ দুইটিই তাদের মনঃপুতঃ শব্দ নয়)  হল সমূহ 'সম্ভাবনা' কে, বলা ভালো সমূহ 'বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানের সম্ভাবনা' কে প্রত্যাখ্যান করা।  ''পোস্ট মডার্ন' এই  আহ্লাদীদের মতে চেতনা বস্তুজগত থেকে স্বাধীন বরং চেতনার দ্বারাই থেকে বস্তুজগত, হয়, চালিত এবং দেরীদা ইত্যাদি মহামানবেরা শেরী-শ্যাম্পেনসহ এই সকল ‘মায়া’র প্রচার চালাতো পাঁচ-সাত-দশ তারা হোটেলের রম্যতায়।

 কথাগুলি বলে রাখলাম এই হেতু যে, এই রচনায় 'ক্ষমতা' ও 'ক্ষমতা খেলা' শব্দ ও শব্দবন্ধ বার বারই ফিরে আসবে আর এই শব্দগুলি  ''পোস্ট মডার্ন' এই  আহ্লাদীদিগের দ্বারা, প্রচারিত হয় ও হচ্ছে, বিপরীত ও বিকৃত অর্থে।

২।

ভাষা, হায়, সে'ও হয় ক্ষমতা-খেলার একটি ঘুঁটি।

হায়, এ'ও নয় কোনো নতুন কথা। সহজতম উদাহরণ, বিজেপি’র ‘promised land’ সেই রামরাজ্যেই শূদ্রের অধিকার ছিলনা শাস্তর ও সমোসকিরিতো পাঠের। প্রসঙ্গত "Is a Compulsory Official Language Needed?" নামে ১৯১৪ সালে লেনিনের বক্তব্যের, শুধু আরম্ভ-অংশটিকেই, এখানে উদ্ধার করছি, আপাততঃ 'The liberals differ from the reactionaries in that they recognise the right to have instruction conducted in the native language, at least in the elementary schools. But they are completely at one with the reactionaries on the point that a compulsory official language is necessary.  ... What does a compulsory official language mean? In practice, it means that the language of the Great Russians, who are a minority of the population of Russia, is imposed upon all the rest of the population of Russia.' ভাষা যে আগ্রাসনের একটি ঘুঁটি সে কথা এখানে স্পষ্ট।

                      একই রচনাতে লেনিন লিখছেনঃ The “arguments” of the Black Hundreds are curt, of course. They say: All non-Russians should be ruled with a rod of iron to keep them from “getting out of hand”. অর্থাৎ ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার মর্মে যে ভাষাটিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে তার ভূমিকা গৌণ। 'কে চাপিয়ে দিচ্ছে', 'কাদের উপরে' এবং 'কেন' এগুলিই লক্ষণীয়। " বর্তমান উদাহরণে

(ক)  'কেন'র উত্তর "All non-Russians should be ruled with a rod of iron to keep them from “getting out of hand”,

(খ) কে চাপিয়ে দিতে চাইছে এবং (গ) কাদের উপরঃ 'the Great Russians, who are a minority of the population of Russia'

                  টলস্টয়, পুশকিন থেকে আরম্ভ করে রাশিয়া-সাহিত্যের নিবিড় পাঠক লেনিন অতঃপর বলছেনঃ "We know better than you do that the language of Turgenev, Tolstoy, Dobrolyubov and Chernyshevsky is a great and mighty one. We desire more than you do that the closest possible intercourse and fraternal unity should be established between the oppressed classes of all the nations that inhabit Russia, without any discrimination. And we, of course, are in favour of every inhabitant of Russia having the opportunity to learn the great Russian language.... What we do not want is the element of coercion. We do not want to have people driven into paradise with a cudgel; for no matter how many fine phrases about “culture” you may utter, a compulsory official language involves coercion, the use of the cudgel." দুইটি শব্দ এখানে দাবী রাখে আন্ডারলাইন করে পাঠ করবারঃ coercion cudgel,জবরদস্তি ও গদাপেটা করে বাধ্য করা, অর্থাৎ আগ্রাসন।

                          একটি ভাষার অকস্মাৎই সম্মান পাওয়া এবং আরেকটি বা আরো কয়েকটি ভাষার হঠাৎই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আবডালে আদতে যা ছিল, যা রয়েছে, তা এই আগ্রাসনের হেতু কে চিহ্নিত করতে পারার ক্ষমতা-অক্ষমতা। এবং এই চিহ্নিত করণের সাফল্য ও ব্যর্থতার উপরেই নির্ভরশীল এই আগ্রাসনকে পরাজিত করতে পারা বা না পারা।

                         যে মুহুর্তে আমি বলছি, যে, চসারের দ্বারাই ইংরেজি ভাষা জাতে উঠেছে বা বঙ্কিমের দ্বারা বাংলা ভাষা সেই মুহুর্তেই আমি ভুলে যাচ্ছি চসারের সমকাল, তার বাস্তবতা। রামমোহন,বঙ্কি্ম, প্রিন্স দ্বারকা বা তাঁর পুত্র, পৌত্রাদির সমকালীন বাস্তবতা।

চসার প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখতে হবে ধর্মযুদ্ধ ও তার সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব। এই সুমহান ধর্মযুদ্ধ বারবার সংকটের সম্মুখীন হয়ে মূলতঃ ল্যাটিন ও ফরাসী বলিয়ে ক্রুসেডার'দের প্রতিপত্তির মূলে হানলো আঘাত। ফলতঃ পূর্বে যাকে বলাহতো 'চাষাড়ে ভাষা', সেই ইংরেজি উঠতে লাগলো পাতে আর এরকমই একটি সময়ে চসারের আগমন। যদি ধর্মযুদ্ধ না ঘটতো বা তার পরিণতি হতো ভিন্নমুখী তাহলে হয় চসারের কেন্টারবেরি-কাহন রয়ে যেতো চাষাড়ে হয়েই। সিলেটি রামায়ন যেরকম। অথবা চসারই স্বয়ং হয়তো লিখতেন ফরাসী বা ল্যাটিনে। Neil Faulkner এর "Crusade and jihad in the medieval Middle East" প্রবন্ধটি উৎসাহী পাঠকের অবশ্যপাঠ্য।

 [ সূতোঃ https://www.marxists.org/history/etol/writers/faulkner/2006/xx/crusade.html#n19 ]

                                 একই ভাবে বাংলা ভাষার আদিরূপকারদের মধ্যে রামমোহন, দ্বারকানাথ ইত্যাদি ছিলেন, মূলতঃ জাতীয় বুর্জোয়া। অথচ এই সাম্রাজ্যবাদী আমলেই অন্য অনেক বিজিত দেশের জাতীয় বুর্জোয়াদের মতো এদের সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের বিপক্ষে খুব কিছু করবার সাহস ছিলনা। কিন্তু ষোলো আনা সাধটি ছিল ইংরেজের মুনাফায় ভাগ বসাবার। এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার কথা বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন মার্ক্স। ভারতবর্ষীয় এবং বাঙালী ও বাংলার সাপেক্ষে এই বিষয়টি বিস্তারে লিখে গিয়েছেন কমরেড সুনীতি (কুমার) ঘোষ। তাঁর The Indian Big Big Bourgeoisie গ্রন্থটি এই বিষয়টিরই নিবিড় বিশ্লেষণ।

     বঙ্গের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদ ভীতি ও তজ্জনিত প্রীতির একটি ফল এতাবৎ ভারতবর্ষে সেই অর্থে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর না জন্মানো আর বঙ্গের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে যে গোপন ক্ষোভ তারই একটি ফল বাংলা নামক 'নেটিভ ভাষা'র ভাষা হয়ে ওঠা। অপরান্তে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের পক্ষে 'নেটিভ'দের মতিগতি বোঝার প্রয়োজনেই প্রভুরা ওতে সায় দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে কেরী সাহেব ও তাঁর মুন্সীহেনরা কোন মানসিকতা কিংবা সততা ইত্যাকার থেকেই বঙ্গ ভাষার সেবা যদিবা করেছেন তথাপি অন্তিমে সাম্রাজ্যবাদেরই প্রয়োজন মিটেছে।

যেহেতু ইংরেজ প্রভুদের উদ্দেশ্য ছিলনা বাংলা ভাষার বিকাশ ও বিস্তার তাই যে মুহুর্তে ওই ভাষার সংবাদপত্র ইত্যাদি সাদা প্রভুদের উল্টো গাইতে আরম্ভ করলো, তৎক্ষণাৎ নেমে এলো দমননীতি। এই সকল দমননীতি তৎকালীন বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া ও এক স্তরের সামন্ত এবং সদ্য গড়ে উঠতে থাকা চাকুরীজীবীকে বাধ্য করলো ভাষার বিকাশে উদ্যমী হতে।

অর্থাৎ ইতিহাসের ওই বিশেষ বাঁকটি, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের্‌ যদি না আসতো তবে নিশ্চিত বিদ্যাসাগর বলতেন না ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কথা। নিশ্চিত মধুসূদন লিখে যেতেন ইংরেজী বা ল্যাটিনে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথও পেতেন না সেই ভূমিকাগুলি যেগুলির নিমিত্ত অদ্য তাঁরা নমস্য। ইতিহাসের ওই বিশেষ বাঁকটি, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের্‌ যদি না আসতো তবে ভাসা ভাসা হলেও, কৃষক-শ্রমিক ও তথাকথিত 'ছোটোজাত'দের আদ্যন্ত বাদ দিয়ে হলেও, যেটুকু জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, তাও উঠতোনা। মোহনদাস করমচাঁদ প্রসঙ্গে এখানে যাবোনা, প্রথমতঃ এখানে আমরা বুঝবার চেষ্টা করছি ভাষা ‘বাংলা’র জন্ম ও বিকাশের পরস্তাব। দ্বিতীয়তঃ কৃষক-শ্রমিক ও তথাকথিত 'ছোটোজাত'দের সঙ্গে মোহনদাস করমচাঁদের মেলামেশাকে যদি মোহনদাস করমচাঁদের সৎ প্রয়াস ও সততা বলে ধরেও নিই তাহলেও মোহনদাস করমচাঁদ শ্রেণী সমঝোতার প্রচারক, শ্রেণী সংগ্রামের নয়।

                       ভাষার ভিত্তিতে গঠিত হলো যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ভেঙ্গে, সেখানেও ভাষা সার্বিক আগ্রাসনের একটি রূপ মাত্র। মূল দ্বন্দ্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সম্পন্ন শ্রেণীর স্বার্থের, সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজির স্বার্থ-সংঘাত। সেখানে শ্রেণী সংগ্রামের কোনো ভূমিই ছিলনা আরম্ভ পর্বে। মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সম্পন্ন শ্রেণীর স্বার্থেরই প্রতিনিধি।তাই,

 অন্ততঃ আরম্ভ পর্বে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি। পরে, পরিবর্তিত পরিস্থিতে অবশ্যই অবস্থান পরিবর্তন হয়েছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিরো। কিন্তু এই মহাযুদ্ধ একটি দেশকে জন্ম দিলেও, প্রায় সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই সংগ্রাম অন্তিমে হয়ে উঠলোনা শ্রেণী সংগ্রাম। যার ফল অদ্যকার বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া, ঘটতে থাকা নানান ঘটনা ও প্রতি-ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত।

পুঁজির সঙ্গে ভাষার উত্থানপতনের এই সূত্র ও বাংলাভাষার, জাতীয়তাবাদের উত্থান পতনে এই সূত্রের প্রমাণ, সে'ও বহু আলোচিত অন্ততঃ মার্ক্স-লেনিন-মাও চিন্তার পথিকদের বৃত্তে। 

 তথাপি যে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বাধ্য বোধ করি, এই মুহুর্তে, তার হেতু, আবহটি নতুন। এই মুহুর্তে পুঁজিবাদ তার সমস্ত পূর্বরূপ, যথা সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সমস্ত পার হয়ে্‌ ভারতবর্ষে পরিগ্রহ করেছে তার বিভৎসতম রূপটি, যা হয়, ফ্যাসিবাদ এবং এই ফ্যাসিবাদের আদি হোতা 'হিন্দু মহাসভা', ক্রমে 'আর এস এস' । এদের বৈধতাকে জ্ঞাপনা এবং ঘোষণা করতে 'বিজেপি' নামক তথাকথিত 'সংসদ' ও 'সংবিধান' মান্য করা 'রাজনৈতিক' দল। অতএব ভাষা ভিত্তিক আগ্রাসনের যে ঘটনা, যে সব ঘটনা ৬০বা বা ৮০'র দশকে ঘটেছিল, সেই ঘটনাগুলির একেবারে সম চরিত্রের ঘটনা আজ ঘটলে তার হেতু ও ফলাফল অবশ্যই জটিলতর, গভীরতর ও বৃহত্তর। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদের স্পষ্ট ফ্যাসিস্ট অবয়ব নেওয়ার মূল্যে এ'ও সত্য যে এই মুহুর্তে এমন সমস্ত ঘটনা, অন্য বৃত্তে এবং ভাষা ভিত্তিক আগ্রাসনের বৃত্তেও, ঘটছে এবং ঘটবে যা ৬০ বা ৮০র দশকে ছিল অকল্পনীয়।

      এন আর সি অবশ্যই এমন একটি ঘটনা যা ঘটিয়ে তুলতে 'হিন্দু মহাসভা','আর এস এস', বিজেপি’র অপেক্ষা করতে হলো আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ব মন্দা’র, পুঁজিবাদের আরো পচনের এবং এই গুলির দ্বারা ফ্যাসিবাদের বিকাশের বিশেষ স্তরটি আসা পর্যন্ত । এমন কি অটলবিহারী আমলেও ঘটনাটি ঘটানো এবং তার সপক্ষে খেতে পাওয়া থেকে খেটে খাওয়া দুই রকমের মধ্যবিত্ত মতামতকে সঙ্ঘটিত এবং সংগঠিত করা ছিল স্রেফ অসম্ভব।

 

 

৩।

এখন, বিশ্বব্যাপ্ত-পাজলের এতোদূর মিলিয়ে ফেলার পরে, তুমি নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছো তোমাকেও, আমাকেও, ওই ভিড়ে?

তুমি কি দেখতে পাচ্ছো ,তোমাকেও, ওই মস্তি দেখতে জড়ো হওয়া ভিড়ের মধ্যে? তুমিও ভাবছো এখন বুঝুক মজা। যতোসব বাংলাদেশী, উইপোকার দল। সরকারের জমি দখল করার ঠ্যালা সামলাক এখন ..." হায়! তুমি কি জানো, যে, প্রয়োজনে তোমাকেও এরা নামিয়ে আনতে পারে রাস্তায়, ঠিক এরকম ভাবেই, 'বাংলাদেশী, উইপোকা'র বদলে 'দেশদ্রোহী, ট্যাক্সচোর' বা অন্য কোনো, যেকোনো অছিলায়, সংজ্ঞায়, ভর করে? তারা কি নামায়নি তোমাকে রাস্তায়? যদি না'ই নামাতো, তাহলে, নিজের ভিটেবাড়ি, ঘরদোর ছেড়ে কেন তোমাকে আসতে হলো এই সকল নগরে, মহানগরে চাকরী জোটাতে? কেন এই মহান রাষ্ট্র হাজির হলোনা 'আচ্ছে দিন' 'আচ্ছে বার্তা' নিয়ে তোমার দরজায় যা আদতে 'সরকার'এর কর্তব্য, দায় -- কর্মের, উপায়ের সংস্থান করা জনতার জন্য? আদতে তুমিও কি জানোনা এই সরকার, কোনো সরকার, কোনো রাষ্ট্রই চায়না, পারেনা এই ব্যবস্থা টুকু করতে কেননা ... সে অনেক কথা। কিছু কিছু তুমি, তোমরা জানো। আমি, আমরা জানি। তবু বলিনা। বলতে গেলে বিপদ আর বলতে চাওয়াকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে এইসব সার্কাস, এই সব বানানো শত্রু -- মুসলমান, বাংলাদেশী, এন আর সি, মন্দির এহি বানায়েঙ্গে, হিজাব, চীন সীমান্তে যুদ্ধ ...

তুমি কি দেখতে পাচ্ছো, তোমাকে, ওই হাহাকারে মেতে ওঠা মানুষদের ভিড়ে? পাচ্ছোনা? তাহলে তোমার দৃষ্টিশক্তি বিকল হয়েগেছে পুরোপুরি আর এ দোষ, দায়, পুরোটা তোমার নয়। এই অন্ধ করে রাখবার, বধির করে রাখবার দায়িত্বই তো রাষ্ট্রের। যুগে যুগে, কালে কালে রাষ্ট্র তো করে এসেছে এই কাজটিই। করে এসেছে কেননা রাষ্ট্র বানাতে গিয়ে মাথাতো কবেই বিক্রি হয়ে গেছে পুঁজিওলাদের কাছে। গদীতে বসামাত্র সেই দাম মেটাতে হয়, হচ্ছে, হবে সব রাষ্ট্রের। তবে এই মুহুর্তে, এই ভারতবর্ষে দামটা চড়ে গিয়ে রাস্তায় নেমেছে পরিষ্কার ফ্যাসিবাদের গেরুয়া টি-শার্ট গায়ে দিয়েই। আবার মজাও এখানেই। এই যারা আজ উদ্বাহু নেত্য করছে দাঙ্গা করায়, লাগানোয়, হোয়াটস্‌এপ্‌, ফেবু,টুইটারে মিথ্যাকে রটানোর, 'অপারেশন রোমিও'র নামে মিটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের কামবিকৃতি ( কাম নিজে বিকৃত কিছু নয়, একটি স্বাভাবিক রিপু কিন্তু তাকে  ভাবে চরিতার্থ করবার ইচ্ছার প্রকারভেদেই বিকৃতি ) এদেরই কিন্তু পরের দৃশ্যে গিলে খাবে সেই তিমি যার পিঠকে আমার, তোমার এখন মনেহচ্ছে ইডেন-উদ্যান বলে। এদের একদল অবশ্যই লুম্পেন, লুম্পেন প্রলেতারিয়েত। এরাই প্ররোচিত হয় খুন, জখমে আর তারপরে তাদের লেলিয়ে দেওয়া বাবারাই বলে 'এদের তো চিনিনা। না না, এরা আমার পার্টির নয়। ফালতু লোক'। ঠিক যেমন আজ ওই সকল মানুষ সরকারের 'ফালতু লোক'।

তোমার, আমার কি মনে নেই মাত্র ২-৩ বছর আগে, বিশ্ববাজারের মন্দার জন্য যখন তোমাকে, আমাকে আমাদের শাদা-কলার পদগুলি থেকে, পদাঘাত করে পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখনকার কথা? তখন এই সকল হোয়াইট-কলার, আইটিবাবুরা কেন ছুটেছিলেন ইউনিয়ন গড়তে? চর্বিভরা, থলথলে পেট নিয়ে মেনেছিলেন মিছিলে? তাদের ক'জন কে, রাম-কসম, ফিরিয়ে নিয়েছে কোম্পানী? তাদের ক'জনের সুরাহার নিমিত্ত এগিয়ে এসেছে সরকার বাহাদুর? কি হয়েছে তাদের নবাবী এপার্ট্মেন্টের যা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ করে কেনা, মাসকিস্তির ভিত্তিতে? তারা হয়তো মড়েনি। দেশবাড়িতে গিয়ে কিছু একটা করছে। হয়তো। কেননা এই হোয়াইট-কলারদের বড় অংশ আসে মধ্যবিত্ত শ্রেনী থেকে এবং এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী হয় সাতিশয় হারামজাদা। সুতরাং এরা টিঁকে যায় তাদের কাঁঠালটি কারো না কারো মাথায়, কোনো না কোনো ভাবে ভেঙ্গে। ওই মন্দায় যাদের অন্যত্র চাকরি জুটলো সে তাদের নিজের 'কানেকশন' বা 'ইন্টারভিউ ক্রেক' কত্রে। সরকার বাহাদুরের সাহায্যে নয়। কিন্তু, কই, এদেরোতো দেখিনা, কদাপি এগিয়ে এসে দাঁড়াতে কিংবা দুটি পংক্তিও লিখতে কোনো সামাজিক মাধ্যমের পাতায়। কমেন্টে। বরং বিএ-এমএ পাশ দেওয়া শিক্ষিকাকে দেখি কৃষক আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্যে কুন্ঠিতা! ‘ হুঁ , স্যুটেড-বুটেড চাষা’ বক্রোক্তিদ্বারা সংঘীদের প্রতি আনুগত্য ঝরায় বদন বহিতে, টুইটারে!

টেলিফোন বিভাগ নিলামে উঠবে। তারই ব্যবস্থা হচ্ছে। অতএব প্রথমেই অস্থায়ী কর্মীদের ছাঁটাই। সেই অস্থায়ী কর্মীরা মাসাধিক কাল ধরে আন্দোলনে, অনশনে। তাদের কিনারে কেন দাঁড়াচ্ছিনা আমি, কেন দাঁড়াচ্ছো না তুমি? যে বা যারা দাঁড়াচ্ছে, তর্কের ফেরে হেরে গেলে বলছো 'ওরা মহান' ঠিক যেমন যে বা যারা বলছে " দাঙ্গাবাজি কোনো পথ নয়। আমার মুসলমান ফোবিয়া নেই" তাদেরো, ঠেকায় পড়ে বলছো 'মহান'। সামান্য বাঁকা হেসে। হায়, মহত্ত্ব কি এমনই সহজ? মহত্ত্ব অর্জন করতে হয়। আদতে না'তো দাঙাবাজি, না'ত মুসলমান ফোবিয়া, হয় কোনো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। অথচ এই অস্বাভাবিকতাকেই তোমাদের কাছে স্বাভাবিক করে দিয়েছে, বহুদিনের চেষ্টায়, কারা? অবশ্যই আদিতে কংগ্রেস এবং অতঃপর আরো বিশদ, আরো সুপরিকল্পিত ভাবে আর এস এস, বিজেপি। তোমার অজান্তেই তুমি, আমার অজান্তেই আমি বিষাক্ত হয়েগেছি। এতোদূর ও এতো গভীর বিষ ছড়ানোর মূলে আমাদের বলা হয়েছে মুসলমান বিনাশ মানেই সমস্ত সমস্যার সমাধান। আমরা হজম করেছি। অথচ, এই আমরাই 'শিন্ডার্স লিস্ট' আর 'ইন্ডেজেনিয়াস বাস্টার্ড' দেখে বাপান্ত করি হিটলারের। নাজিদের! হায়, আমরা নিশ্চিন্ত পিকনিকে মেতে আছি, অদ্যাপি, আগ্নেয়গিরি শিখরে। নিশ্চিন্তে বসে আছি ডুবন্ত তিমির পিঠে।

 

৪।

যাদের সেদিন পথে নামিয়ে আনা হলো দিল্লীতে, বলা হলো 'বাংলাদেশী', বলা হলো এদের 'ভাষা'য় নাকি এমন একটা 'বাজে' টান আছে, 'ডায়লেক্ট' আছে তাতেই দিল্লীর পুলিশ সহ সক্কলে টের পেয়ে গেলো যে এরা বাংলাদেশী! এখানে ঠিক কি কি ঘটে গেলো? আপাত ভাবে 'জবর দখল' জমি থেকে উৎখাত, যদিও সে'ও হয়নি এই তথাকথিত সংবিধানের একটিও নিয়ম মেনে, কিছু 'বাংলাদেশী'র কিন্তু আদতে যারা নয় কাঁটাতার পার হয়ে আসা, তারা পশ্চিম বাংলার নিতান্ত গরীব জনতা। যাইহোক, এই ঘটনাটি থেকে দেখা যাচ্ছেঃ

১। যতো দোষ সন 'বাংলাদেশী'র

২। সেই 'বাংলাদেশী'রা বাঙ্গালী নয়। এরা কি এক বদখত ভাষা বলে। অর্থাৎ মহানগর কলিকাতার ভাষাকে বাংলা বলে পরোক্ষ সাট্টীফিকেট দেওয়া হল।

 হঠাৎই পঃবঃ বাংলার প্রতি দরদ কেন? না, এই দরদ আজকের নয়। এই দরদ কিছু বছর আগে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে কবর খুঁড়ে তুলে আনা দিয়ে সূচিত। এতে যা করা গেলো তা হলো বিজেপি বা আর এস এস এর 'গো বলয়' দুর্নাম ঘুচানোর মাধ্যমে বাঙালিকে 'ভকত' হতে তাত্ত্বিক উৎসাহ প্রদান। যার ফল হিসেবে আমরা দেখলাম পশ্চিম বাংলায় বিজেপির তুলকালাম। দেখলাম বাঙ্গালীর মগজকে ব্যবহার করা হলো রবীন্দ্র-বিরোধী 'খুফিয়া' প্রচারে। দেখলাম বাঙালীর 'হিন্দু' হয়ে ওঠা। এর ভোটের দিকটি আমার কাছে নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু ফ্যাসিবাদের নতুন ঘাঁটি নির্মাণের প্রশ্নে এটি অতি ভয়ংকর একটি ঘটনা।

 পঃবঃ'র বাংলা কি অদ্য বাংলা আর? বাংলা টিভি চ্যানেল,এপ্‌ ইত্যাদির দৌলতে আসাম বা ত্রিপুরার প্রত্যন্ত মফস্বলেও যে ভাষায় কথা বলা হয়, সে কি বাংলা? ৮০ থেকে ৯০ ভাগ হিন্দি গিয়েছে ঢুকে। নিজেদের অজান্তেই। নগরে, মহানগরে ঢুকে গিয়েছে ইংরেজি এবং শুধু বাংলায় নয়, তেলেগু, তামিল, কন্নড় সর্বত্র। এই সময়ে বেংগালোরে দুইজন বাঙ্গালী যুবক বা যুবতী যখন বাক্যালাপ চালাচ্ছে সেখানে ৪০ ভাগ ইংরেজি, ৪০ ভাগ হিন্দি, ২০ ভাগ হয়তো বাংলা। কলিকাতা মহানগরীতেও তা'ই। গঞ্জে গ্রামে ইংরেজির বদলে বেশীরভাগটাই হিন্দি।

সমস্যা হিন্দি ভাষা নিয়ে নয়। সমস্যা অসমীয়া ভাষা নিয়ে নয়। ১৯,২০,২১ ইত্যাকার তারিখের খুচরা ও পাইকারী, ভেজ ও ননভেজ, এলোপ্যাথিক ও হোমোপ্যাথিক বিক্রেতাদের কথা জানিনা, তবে যেটা যুক্তি, হ্যাঁ এখানে যুক্তি মানে মার্ক্সবাদী যুক্তি, তাতে যা টের পাই, তা এই, যে, একটি বা দুটি বিশেষ গোষ্ঠির ভাষাকে আরো অনেক গোষ্ঠির উপর চাপিয়ে দিতে চাওয়ার চেষ্টা, হয় আর সমস্ত আগ্রাসনের একটি অথবা আগ্রাসনের ঘোষণা। অসমীয়া ভাষা অনসমীয়া আসামবাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আসামবাসীর সেই শ্রেণীর যাদের কারবার নানা রকমের মুনাফা নিয়ে। অসমীয়া চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সফল হলে অন্তিমে সেই শ্রেণী, শ্রেণিগুলিই হয় লাভবান। সরাসরি বিত্তলাভ হয় কিংবা পরোক্ষে। আর এই সমস্ত পুঁজিবাদী চক্রান্তে সততই তারা জোগাড় করে নেয় একদল লুম্পেন যারা হাতে মারে ও চিহ্নিত হয়। যারা ভাতে মারে তারা বিপাকে পড়লে সোজা জানান দেয় 'এদের চিনিনা'।

কথাটি, প্রকৃত প্রস্তাবে, হয় এই, যে, সে’ই ভাষাই হবে পাড়াভাষা, পরগনা-ভাষা, রাজ্যভাষা,রাষ্ট্রভাষা,বিশ্বভাষা যে ভাষা পুঁজির মদতে পুষ্ট। কেন বেসরকারী ব্যাংকের, কোম্পানীর বিজ্ঞাপন, কামকাজ, তোমার বরাকে হবে বাংলায়? হবেনা। কেননা আসাম রাজ্যে তুমি সংখ্যায় কম আর ওই কম সংখ্যার জন্য আলাদা করে বাংলা বিজ্ঞাপন, ফর্ম, হ্যানো-ত্যানো ছাপানো, ওই পুঁজিপতির, ওই পুঁজিপতি গোষ্ঠীর অনর্থক খরচ। সে ব্যবসা করে কোমোডিটির। সে পাইকারি হারে অসমীয়া বিজ্ঞাপন ছাপবে আসামের জন্য।

      সে পাইকারি হারে অসমীয়া বিজ্ঞাপন ছাপবে আসামের জন্য? ঠিক। কিন্তু কতো দিন? ভারতের পুঁজি অধুনা যাদের কুক্ষিগত তারা তো অসমীয়া নয়। তারা গো-বলয়। তারা, ক্রমে, সারা ভারতবর্ষের নিমিত্ত এক ও একটি ভাষায় বিজ্ঞাপন থেকে ফর্ম, হ্যানো-ত্যানো ছাপানোর দিকে যাবে। সরকার তাকে সাহায্য করবে। কিভাবে? সেই একই ভাবে কি যখন ব্যাংকিং এর হাতধরে, জনতার টাকা ওরা তুলে দিয়েছিল, ঋণ হিসেবে পুঁজিপতিদের কাছে? না। সেভাবে নয়। এইবারে তাদের সহায়তা হবে আরো প্রকাশ্য, আরো টেক্‌টিক, আরো নগ্ন। কেননা পুঁজিবাদের পচন এইবার ফ্যাসিবাদের ঘা হয়র, পূঁজ হয়ে প্রকাশ্য। তার আর দরকার নেই সংসদ-সংবিধানহেন আড়াল-আবডালেরো। ৬০ বা ৮০’র দশকে কামান নামেনি জনতাকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে। পুলিশ “বাধ্য হয়ে” গুলি চালিয়েছে শুধু। এইবার মিলিটারি “বাধ্য হবে” কামান দাগতে। অদ্য বরাকে। আগামীকল্য লুইতে। কেননা পরের স্তরেই আসবে লুইত, যদি সে চায় তার সরকারী, বেসরকারী বিলি ব্যবস্থা অসমীয়াতে বজায় রাখতে। যে কর্নাটক অদ্য বিজেপি’র জঘন্যতম নিরীক্ষাগুলির একক মানচিত্র, সেখানেও, একটি স্তরে বাঁধবে ওই ভাষা যুদ্ধ যা তামিলনাডুতে বহুকাল উপস্থিত।

                      আসাম আন্দোলন, বঙালখেদা এই সমস্তের আরম্ভও ওই আসামের পুঁজি যাদের হাতে তাদেরই দ্বারা। আসামের পুঁজি যাদের হাতে তারা সম্পূর্ণ বুর্জোয়া নয়। তাদের অর্থনীতিতে ও সংস্কৃতিতে অদ্যাপি মিশে আছে সামন্তবাদ। তাই ‘peaceful evolutionary transformation of feudalism’ এখানে চেহারা নিলো অশান্তির, গণহত্যার, চোরাগুপ্তা মারপিটের। ১৯৭৯ এ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ( লিবারেশন),  CPI-ML(L) জনতার কাছে যে আবেদন রাখে তার একটি অংশ এখানে উদ্ধার করা প্রাসঙ্গিকঃ

“It is quite true that a section of Bengali intellectuals suffer from a false sense of superiority and look down upon the Assamese people as backward and uncultured. This is a legacy of the past and a thing created by the British rulers.

The British followed the policy of drawing intellectuals of some particular nationalities closer by placing them in important executive posts and by other measures at the expense of other nationalities. Such policies they pursued at different places of India. This way, on the one hand, they won over considerable sections of some nationalities to their side, and on the other, created the impression among other nationalities that not they (the British rulers) but the favoured nationalities who were their enemies. This is how they created divisions among the people and ruled our country for so many years. It is only in the course of common struggle against the British rulers that the Indian people of different nationalities built up their unity.

 

So there is a history of Assamese-Bengali rift and there is also the history of their united struggle against the common enemy.

After 1947, the ruling classes have tried in thousands of ways to break up the fighting unity of the people and, as the enemy is now more disguised, it is easier for them to do so. When we got 'freedom' the motherland was cut into two pieces and after 32 years of 'independence' we face the endless rifts among different sections of people. In Assam, all the political parties have so far thrived on the Assamese-Bengali rift. In other parts of India, they thrive either on Hindu-Muslim divide or on caste issues.

Would any problem of the Assamese people be solved by driving out the Bengalis and Nepalis from Assam ? No. It will only break the peoples' unity, make them waste their energy fighting each other, and only imperialists and domestic reactionaries will derive benefit out of it. It will create more problems for the Assamese people than it will solve.”

                                    আরম্ভটা এইভাবে হলেও পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে লাগলো একেকটি বাজার মন্দাকে ভর করে বিজেপি, আর এস এসের ফ্যাসিবাদী চরিত্র যতো যেতে লাগলো পূর্ণতার দিকে। সেই করসেবা হয়ে, যে প্রসঙ্গে আগেই বলেছি। এইবার এন আর সি তে আমরা যে চেহারা দেখলাম তা কিন্তু আসাম আন্দোলনের মতো নিতান্ত মারামারি, খুনাখুনি নয়, কোনো 'আনরেষ্ট' নয়। এবার আসামের ওই পুঁজি-পকেট শ্রেণীকে নেতৃত্ব দিলো স্বয়ং ফ্যাসিবাদ। 'খুল্লম খুলা' ফ্যাসিবাদ।

একই ভাবে শ্যামাপ্রসাদ দেখিয়ে বাঙালিকে 'ভকত' করে টলার তলে তলে ফ্যাসিবাদ এ'ও করেনিলো, যে, বাঙালীর ভাষায় ভরে দিলো ৯০ ভাগ হিন্দি। এবারে তারা অবশ্য চাইবে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দিতে সমস্ত অহিন্দি জনতার মস্তকে। এইভাবে হিন্দু মহাসভা, আর এস এস, বিজেপি পূর্ণ করবে তার এই স্তরের ফ্যাসিবাদের একটি পর্ব। অতঃপর যাবে পর্বান্তরে। অতএব শুধুমাত্র 'ভাষা আন্দোলন' আর একটি দুটি সাইনবোর্ড-পোস্টার ছেঁড়া,নামানো বা এখানেওখানে একটি দুটি বেদী আর ভাস্কর্য স্থাপনের দ্বারা কিছুই হওয়ার নয়। যদি হতো তাহলে এন আর সি'র আঘাত এতো গভীরে ক্ষত করতে হতোনা সক্ষম। অন্ততঃ বরাকে। আর বরাকে যদি এই প্রতিরোধটুকু উঠতো গড়ে তাহলে সেদিন দিল্লীতে এই সকল মানুষকে মধ্যরাতে ঘরছাড়া করবার পরিকল্পনাও, নিশ্চিত, হতোনা এতো সহজে। কেননা এই সমস্তই একই ফ্যাসিবাদের নানান মুখ।

ফ্যাসিবাদের  সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। তবে ভারতীয় অনুষঙ্গে ফ্যাসিবাদের চরিত্রটি নিয়ে কিছু বলা অবশ্য কর্তব্য। সর্বস্বীকৃত সত্য এই, যে, ফ্যাসিবাদ বলে এমন এক সর্ব-সমস্যা-হর অতীতে জনতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা যে অতীত আদৌ ছিলই না। ভারতে সঙ্ঘীরা একেই বলে “রাম রাজত্ব”।এই মিথ্যা অতীতে ফিরে যাওয়ার পথে ফ্যাসিবাদীরা আমদানী করে কাল্পনিক শত্রুর। সংঘীদের ‘মুসলমান’, নাজিদের ইহুদী। ক্রমে এই গুল গপ্পোটিকে তারা করে তোলে হেজিমনি – একদা গোয়েবল আর হালের হোয়াটসেপ্‌, ফেবু,টুইটার, অন্যান্য গণ মাধ্যম যাতে পালন করে, করছে দূতের, দূতীর ভূমিকা। তারা তোয়ের করে গোপন ক্যাডার বাহিনী। ভারতে এই বাহিনী আরএসএস। এইভাবে তারা তোয়ের করে নেয় তাদের একটি অবস্থান। অতঃপর তারা, সিলেটিতে যাকে বলে “খাপ পেতে থাকে” । যে মুহুর্তে পুঁজির বাজারে মন্দা নামে, যে মুহুর্তে পুঁজিবাবাদের সংকট উপস্থিত, তক্ষুনি গণচক্ষু থেকে সেসব আড়াল করে আপামর জনতাকে পুঁজির বৃহত্তম বাবাদের স্বার্থে কাজে লাগায়, সামান্য ছল-কৌশল আর ৯৯ শতাংশ বল দ্বারা। এমনি এক মন্দায় তাদের জন্ম, বৃটিশ যুগে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় হয়ে। আরেক বাজার মন্দার সুযোগ নিয়ে তাদের ‘করসেবা’, বাবরি-রাম দাঙ্গা। আর হালের মন্দায় তারা খোলা তলোয়ার হাতে গৌরী লঙ্কেশ হত্যা থেকে ‘এনআরসি লাগাও, দাঙ্গা বাধাও’, ‘মন্দির এহি বানায়েংগে’, ‘বোরখা পুড়িয়ে খাক করেঙ্গে’ , ‘কাশ্মীর ফাইল ফ্রি মে দিখাকে পাব্লিক কো আউর দাঙাবাজ বানাও’, প্রকাশ্য সভায় 'মুসলমান নিধন করো' ঘোষণা , নিতান্ত নির্দোষ উমর খালিদের অনন্ত জেলবাস, স্টেন স্বামীর হত্যা ইত্যাদির দ্বারা জানান দিচ্ছে যে ফ্যাসিবাদের ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা শ্রম, হিন্দু মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে মুসলমানদের উঠে যাওয়ার হুমকি, হচ্ছে নতুন নতুন অনর্থক কিংবা অনর্থ শব্দ আমদানি করে সেগুলির ভিত্তিতে চোখ-কান খোলা রেখে চলা যে কোনো মানুষের মানবাধিকারে আক্রমণ, যথা 'আর্বান নকশাল' শব্দটি।

এবং এই সমস্তেরই একটি ভাষিক আগ্রাসন। বরাকে অসমীয়া, ভারতে হিন্দি। তবে এখানেই নিহিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ও তার রক্ষা কবচ 'রাষ্ট্র' নামক যন্ত্রের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব। যদি 'হিনহি' হয় সরকারী ভাষা তাহলে আসামের কি হবে? ঠিক যেমন আরেকটি স্তরে এসে যখন এই ফ্যাসিবাদ, তার নিয়মেই, আঘাত হানবে অধুনা 'ভকত' খাতায় নাম লেখানো 'অ-বাংলাদেশী' 'বাঙালী'র উপর, তখন কি হবে ওই 'ভকত'দের? ওই 'ভকত'দের মধ্যে যে মিশে আছে, মিশে গিয়েছে, ফ্যাসিবাদী প্রচারের ধোঁয়ায় পথ হারিয়ে, বহু বহু বহু প্রকৃত প্রলেতারিয়েতও! এদের ধ্বংস মানে আমাদেরো ধ্বংস আর এই ধ্বংসই তো, কিছু কিছু বিশেষ শ্রেণীর আদতে চায় ফ্যাসিবাদ! আর এই সর্বাত্মক ধ্বংসকে রুখে দাঁড়াতে গেলে প্রয়োজন সর্বাত্মক প্রতিরোধের। আর এই প্রতিরোধ ততোদিন গড়ে উঠবেনা, উঠতে পারেনা যতোদিন না ওই উচ্ছেদ রুখে দেওয়ার আন্দোলনে, হিজাব-আন্দোলনে,এন আর সি'র আন্দোলনে, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের আন্দোলনে এসে মিশবে না ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা আন্দোলনকারীরা অথবা যতক্ষণ না এই সমস্ত আন্দোলনগুলি একই সঙ্গে গর্জে উঠবেনা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী, ততোদিন ১৯,২০,২১ ইত্যাকার তারিখের খুচরা ও পাইকারী, ভেজ ও ননভেজ, এলোপ্যাথিক ও হোমোপ্যাথিক বিক্রেতাদের একটা বাজার থাকবে যা আদতে আড়াল করে রাখবে ফ্যাসিবাদের প্রকৃত আগ্রাসন।

একদিন মধ্যরাতে এমনি বুলডোজার এসে আমাদেরো নামিয়ে আনবে পথে – খর্ব করে নাগরিকের থুড়ি, ফ্যাসিবাদের কাছে নাগরিক, গ্রামীন,মানব এই সকলের নেই কোনো অর্থই, অতএব আমার,তোমার সমস্ত তথাকথিত ‘মানবাধিকার’ পিষেযাবে মিলিটারি বুটের তলায়। অতএব সম্মিলিত প্রতিরোধই একমাত্র সহায়, এক ও অন্তিম কর্তব্য আমাদের। আমাদের সকলের, প্রত্যেকের।

অতিমে বলি, যে, এই সমস্ত প্রতিরোধকে একত্রিত করে ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে ব্যারিকেড গড়ে তোলার সচেতন দায় টি কিন্তু মার্ক্স-লেনিন-মাও চিন্তার প্রকৃত পথিকদেরই নিতে হবে। ১৯৯১ সালে, আসামে প্রকৃত কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে বিনোদ মিশ্র বলেছিলেনঃ “as the bourgeoisie is no longer capable of taking this revolution to its logical end, the historical duty has fallen on the shoulders of the proletariat.” কথাগুলির প্রাসঙ্গিকতা সেই সময়ের নিরিখে সত্য, এই মুহুর্তে সত্য তর। হ্যাঁ, গো পাঠিকা, হে পাঠক, তুমি, আমি, তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি যাওয়া যদু মাস্টার, ওই গোঁফ হারানো বড়বাবু, ওই পিলের জ্বরে ভোগা গঙ্গারাম, এই যে গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি,এই যে কাঠবুড়ো আদতে আমরা সকলে, প্রত্যেকেই এই প্রোলেতারিয়েৎ যতোটা কাছাকাছি তার চেয়ে আলোকবর্ষগুণ দূরে বুর্জোয়া শব্দটি থেকে। অতএব এই ডাক আমাদের নিমিত্ত। এই ডাকই আমাদেরকেও দিতে হবে ছড়িয়ে।  উচ্ছেদ রুখে দেওয়ার আন্দোলন, হিজাব-আন্দোলন,এন আর সি'র আন্দোলনে, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের আন্দোলন, ভাষা-আগ্রাসনের বিপক্ষে আন্দোলন এই সমস্তকে মিলিয়ে দেওয়ার দায় আমাদের।

আমাদেরই।

 

২৬ এপ্রিল, ২০২২

বেঙালোর

 

 

 

 

 

 

জনমত

কয়েকটি প্রশ্ন, একটি ভূমিকা