কয়েকটি প্রশ্ন, একটি ভূমিকা
পাঠিকা, পাঠক – আমি আশা করছি আপনি/তুমি/তুই ও নিজের অবস্থান ও তার নিজস্ব বিশ্লেষণের চেষ্টা নেবেন। উত্তর দেবেন
কয়েকটি প্রশ্ন, একটি ভূমিকা
“লিবারেল” গণ – অসৎ লিবারেল অথবা সৎ – সিলেটিতে “কানা, মনে মনে জানা”র সূত্রে – নিজেদের দৌড়, মোল্লা হেন, জানা আছে, কার কোন মশজিদ অবধি। এ’ও বহুযুগ বুঝিয়ে বলবার অপেক্ষা রাখেনা, যে, “লিবারেলি” গণ আদতে পেটি বুর্জোয়া। যা কিঞ্চিত বিশদ করা দরকার তা হলো এদের ভূমিকার বিশেষত্ব। লিবারেলি দল যায়, গেছে, যাবে – নানান মিটিং, মিছিলেও কিন্তু সে সকল মিটিং, মিছিল, কমিটি – কদাপি রাষ্ট্র নামক কাঠামোর বিরোধিতা করবেনা – গোপনেও। রাষ্ট্র যে একটি অমিমাংসিত দ্বন্দ্বকে ধামা চাপা রাখবার ব্যবস্থা মাত্র, ‘রাষ্ট্র’ এই কাঠামোটিকেই যে উপড়ে ফেলবার প্রয়োজন – এ তারা দুঃস্বপ্নেও, তিনশো পেগ রাম, হুইস্কি বা সাড়ে চারশো দশমিক তিন স্কচের পরেও ভাবেনা, ভাববে না। তারা অবলীলায় পদ্য লিখে শেষ লাইনে জুড়ে দেবে “আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি” আর তা’ই দেখে “আমিও কম কিসে” জনিত মস্তিতে, আরেক লিবারেল উপন্যাসের নাম, যে উপন্যাস মূলত একটি যৌন পুস্তিকা, দিয়ে দেবে “আরব গেরিলাদের সমর্থন করি”। কিন্তু কখন? যখন এই সকল পংক্তি বা নামের মূল্যে থানা-গারদ সম্ভাবনা নেই। ঠিক যেমন হালের কৃষক আন্দোলনে দেখা গেলো। দেখা গেলো একদন ‘লিবারেল’ আর পারলোনা ওই সিংহ চর্মে নিজেকে আবৃত রাখতে। আন্দোলনরত কৃষকদিগকে যেভাবে সম্ভব আক্রমণ করে বসলো মিডিয়ায়, সোসাল মিডিয়ায়। আরেকদন লিবারেল দেখালো সমর্থন। মস্তি এই, যে, এই সমর্থক লিবারেলরা নিশ্চিত ছিল, যে, এই সমর্থনের মূল্যে তাকে থানা-গারদ যেতে হবেনা, চাকরি হারাতে হবেনা। বা এই আন্দোলনরত কৃষকরা এসে আশ্রয় চাইবেনা, দখল করে নেবেনা তাদের সুখ সুবিধা, তাদের সাধের ফ্ল্যাটবাড়ি – ইত্যাদিতে। যদি তেমন ঘটবার সম্ভাবনা হয়, তখন লিবারেলিরা তাদের ল্যাজ কিভাবে নাড়ায়, কিভাবে গোটায়, আমরা দেখেছি। আন্দোলনরত কৃষকেরা আদতে কতোটা কৃষক আর কতোটা ভূস্বামী, তাদের “পাগড়ি সামাল জাঠ” শ্লোগানে মিশ্রিত কতোটা জাত বিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ – সে আরেক প্রশ্ন, আরেক তর্ক।
কিন্তু লিবালেরি’রা এখানে আমার আলোচ্য নয়। আমার আলোচ্য, আমরা নিজেদের মনে, মতে, “লিবারেলিদের চেয়ে এগিয়ে আছি” – আমাদের যাদের অবস্থান, আমরা যারা নিজেদের মনে করি “শ্রেণী শোষন ও শ্রেনী সংঘর্ষের পক্ষে”, আমরা যারা অল্প বিস্তর যোগ রাখি, সমর্থন করি ভোটের দামে বিকিয়ে না যাওয়া এক বা একাধিক বামপন্থী সংগঠনকে, আমার প্রশ্ন তাদের কাছে, তাদের নিয়ে।
সহজ কথায় লিবারেলি দের সুবিধাবাদী অবস্থান – সুবিধাবাদী এইহেতু, যে তাদের এই লিবারেলিত্ব তাদের নিজের শ্রেণীর বিপক্ষে যায়না, অতএব যায়না শাসক শ্রেনীর বিপক্ষেও – আর আমাদের অবস্থানকে আমরা যদি মনে করি – আমাদের নিজ শ্রেনীর পক্ষের নয়, বিপক্ষের, শ্রেনী বিলোপের, তাহলে একটি প্রশ্ন এই, যে, এই রূপ অবস্থানের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটি ঠিক কি?
এই দেশে, অবিভিক্ত কাল থেকে ভাগের মা’র পাতে পড়ার পরেও, আমরা দেখেছি, আদি কমিউনিস্টদিগের বৃহদাংশই এসেছে তথাকথিত জমিদার বাড়ি থেকে। এই ঘটনা লিক্ষ্য করা যায় তথাকথিত “স্বাধীনতা আন্দোলন” এর তথাকথিত “চরমপন্থী” শিবিরেও। কিন্তু এই সকল “চরমপন্থী” আন্দোলনের কোনো শ্রেণী চরিত্র যে ছিলনা, ভগৎ সিং ও তাঁর রাজনৈতিক দল যে একমাত্র ব্যতিক্রম বা সূর্য সেন গোষ্ঠীর কয়েকজনের পরে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়া ( এবং ক্রমে বুরোক্রিসি তে লীন হয়ে যাওয়া সিংহ ভাগেরই) ভিন্ন আর কিছুই ছিলনা, যা’তে করে তাদের মর্মে এই ভীতির সঞ্চার সম্ভব, যে “স্বাধীনতা” আর জমিদারি বিলোপের মধ্যে যোগ থাকা সম্ভব, এই কথাটিও ভাবনার অবকাশ রাখে।
আবার পরে দেখেছি অনেক জমিদার পুত্রই নিজের জমিদারী, যা ছিল, যেটুকি ছিল বিলিয়ে টিলিয়ে দিয়েছেন। এই সকল বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে শ্রেনী সচেতনতা, এই সকল বিলিয়ে দেওয়ার মূল্যে নিজেদের শ্রেণী অবস্থান থেকে মুক্ত হয়ে এসে ডি-ক্লাসড হওয়ার ইচ্ছা, চেষ্টা – কতোদূর ছিল তা’ও প্রশ্নোত্তরের প্রতীক্ষা করেনা কারন তেমন কিছু, “কোয়ান্টেটিভলি” ঘটেনি, যাতে করে এই সকল “বিলিয়ে দেওয়া মহারাজ” দিগকে নিজ শ্রেনী চেতনার উতখাতের পথিকৃত বলে আমরা ধরে নিতে পারি।
প্রশ্নটি নিজেকে ঘিরেই উঠেছিল। ক্রমে একটি অবয়ব নিলো যা অনেকের কাছেই হয়তো আবেদন রাখতে সক্ষম হতেও পারে।
প্রশ্ন এই, যে, ঠিক কি, কি কি কারনে, একজন পেটি বুর্জোয়া, আমার-তোমার মতো, আপনার মতো, নিজ শ্রেনী অবস্থানের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়াতে পারে? পেটি বুর্জোয়া তথা বর্নহিন্দু। অবশ্যই। এই দেশে ক্লাস আর কাস্ট আশ্চর্য এক, একই সমীকরনের একেকটি চলক (variable)।
নিজের অতীতে তাকালে দেখি কিছু কিছু ঘটনা, যেগুলি নিতান্তই কাকতালীয়। যেমন, অতিবাল্যেই আমাকে বাস করতে হয়েছে, বেশ কয়েক বৎসর মা-বাবা ছাড়া – নিজের পিসী আর বাবার পিসীর সঙ্গে। বাবার পিসীটি সেই ব্রাহ্মণ্যদিনের “জেলেও ব্রাহ্মণের হাতের রান্না” খাওয়া আঞ্চলিক “মহামানব” এর জেলখাটা, বাল্যেই পতী-ছাড়া হওয়া পুত্রী। এঁর প্রতি টান থাকলেও, মা’র সংগে যোগাযোগ রাখতে বাধা সৃষ্টি করবার কারনে, অবচেতনে এঁকে, এঁর সমগ্র অবস্থানকেই আমি নিশ্চিত নিগেট করেছিলাম। ফলে ইনি যা’ই বলেছেন খারাপ – যেমন “মুসলমান”, “কাইস্থ বিয়া করা”, “কমিনিস্ট হওয়া”, “ইন্দিরা গান্ধীর বিপক্ষে বলা” – সে’ই সমস্তের ‘নিগেশন অফ নিগেশন’ হয়ে, নিজের অজান্তেই, একটু বড় হয়েই, টের পেয়েছি, আমি ঠিক বিপরীত পথেই হাঁটছি। – ওই উলটো হাঁটার পথে, ঘটনা চক্রে বাবা’র বামপন্থী হওয়া, ইমার্জেন্সিতে জেলে যাওয়া, আলমারি খুলেই মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন রচনা’র প্রচ্ছদ – আমার হয়ে ওঠার অত্যন্ত জরুরী ঘটনা।
কিন্তু এ সকলই আকস্মিক। না’ও হ’তে পারতো। যদি, ধরাযাক, বাবার ওই পিসীটি হতেন মুসলমান না-বিদ্বেষী, হতেন জাতপাত না-বিশ্বাসী, তাহলে?
এখানেও দেখি দ্বান্দ্বিকতা। এঁর এই সকল ধ্যান ধারনাকে শিশুমন, পরে বালক মন না বুঝেই বিরোধীতা করলেও, তাঁর বই-পড়া বাতিক আমাতে বর্তে ছিলো। বইপড়া বাতিক আমার বাবা-মা’রও ছিল। কিন্তু যেহেতু বাল্যের দীর্ঘ সময় আমার সামনে ছিলনা মা-বাবা, আসতো যেতো শুধু, মা’কে তো রাতে থাকতেও দেওয়া হতোনা – আমি তাদের দৈনন্দিনতা দেখিনি তখন। কিন্তু বই-নেশা আমি ওই দিদিভাই, বাবার পিসীটির, কাছ থেকে পেয়েছিলাম।
এখানেও আসে আকস্মিকতার প্রশ্ন। মনোবিজ্ঞানের সূত্রে, কোনো না কোনো ভাবে ওই মহিলাকে নিগেট করাই ছিল আমার নিয়তি। কিন্তু ঠিক কিভাবে নিগেট করা? তার কোনো ফর্মূলা নেই। আমার মন তাঁর বই-পড়াকে নিগেট করে, নিজের মধ্যে নিতে পারতো তাঁর অন্যান্য ধ্যান ধারনাকে।
ভাঙাগড়ার এই ক্রীড়া আদতে চলেছিল, বড়জোর ক্লাস নাইন অব্দি। – এরপরে, নিজের অজান্তেই নিজেকে “কমিউনিস্ট” ভাববার মধ্যে গর্ব টের পাওয়ার আরম্ভ। যদিও এই গর্ব ১৪ বছরের নাবালকের “শহীদ হবো” ভেবে শিউরে ওঠা ছাড়া আর কিছুই নয়, তবু এই শিউরে ওঠার মূল্যেই অনেক বালকের প্রাণ গেছে। আমিও ‘কমিউনিস্ট’ “হয়ে গেছি”।
পরের অংশের যুক্তি ভিন্ন। নিজে নিজে নিজেকে “কমিউনিস্ট” বলে ‘ব্যাপটাইজ’ করার পরের পর্বে ‘কমিউনিস্ট’ রাজনীতির সংগে জড়ানো আর তারপরে প্রশ্ন আর উত্তরের সন্ধানের ভিত্তিতে, যৎসামান্য পাঠ ও আরো সামান্য সক্রিয় কাজের মূল্যে, ক্রমে নিজেকে আবার “বাপটাইজ” করা – না-লিবারেলি হিসেবে, “শ্রেণী সংগ্রাম” এর স্বঘোষিত ঝান্ডা বাহক হিসাবে।
মুখে যা’ই বলিনা কেন, বাস্তব এই, যে, নিজেকে প্রথমে “কমিউনিস্ট”, পরে “না-লিবারেলি “শ্রেণী সংগ্রাম” ঝান্ডা বাহক” হিসাবে “ব্যাপটাইজ” করার মধ্যেও, বা করার মূল্যে আমাকে, এতাবৎ হারাতে হয়নি কিছুই। সুতরাং, “প্রেক্সিস” প্রশ্নে আমি যতোদূর “বিপ্লবী”, স-পেন্সন স-ফ্ল্যাট রিটায়ার্ড পোবেসার, করিমগঞ্জের বাড়ি বেচে কলকাতায় বাস করা মোহন চক্রবর্তীও, ততোটাই “ডি-ক্লাসড” যতোটা “পেন্সনের থেকে সামান্য নিজের জন্য রেখে বাকি সবই দিই বিলিয়ে” ঘোষনায় নিহিত।
এখন প্রশ্ন এইঃ
১। এই যে অবস্থান, স্ব ঘোষনার মূল্যে লিবারেলি থেকে এগিয়ে থাকা, এ কি বাস্তবেই কোনো অবস্থান?
২। নিজ ব্যক্তি স্বার্থে আঘাত লাগলে কেন্নোর মতো নিজেকে গুটিয়ে নেবো। – নিয়ম তা’ই বলে। সম্ভব কি, এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানোর কোনো প্রক্রিয়া? জনতার রাজনীতিতে না গিয়েও?
৩। ‘জনতার রাজনীতিতে না গিয়েও’ – কারণ, নিজ যাপনের এতাবৎ অবজেক্টিভ কন্ডিশান দেখে, ব্যাখা করে, মনেহয়, সর্বহারা যাপন তো দূরস্থান উচ্চবিত্ত, সুবিধা সুযোগ সহ সিটি-লাইফ ভিন্ন আমার ( আরো অনেকেরই) যাপন অসম্ভব। সেক্ষেত্রে ঠিক কিভাবে আমি বা আমরা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেওয়ার পক্ষে আদতে, আদপেই দাঁড়াবো?
৪। আপনার/তোমার/তোর মমে আরো কোনো প্রশ্ন উঠলে যুক্ত হোক।